১৯৫২ থেকে আজ পর্যন্ত এরকম সাংসদ দেখেনি যাদবপুর কেন্দ্র, রীতিমতন সংগঠন সাম্লাতে ময়দানে নেমে পড়েছেন সায়নী, হারের চুলচেরা কারণ চিহ্নিতকরণ শুরু
অম্বর ভট্টাচার্য, তকমা নিউজ, সোনারপুর, ১৫ই জুন ২০২৪ : ১৯৫২ সালে প্রথম লোকসভা নির্বাচন হয় যাদবপুর কেন্দ্রে। আর সেই থেকে আজ পর্যন্ত যত সাংসদ যাদবপুর কেন্দ্রে হয়েছে জয়ের পর আর বিশ্লেষণ করে দেখেন নি জয়ের মধ্যে যদি কোথাও হার হয়ে থাকে তার পিছনে কারণ কি। কিন্তু এবার এই কেন্দ্রে তৃণমূল কংগ্রেসের যিনি প্রার্থী ছিলেন সেই সায়নী ঘোষ কিন্তু নির্বাচনী প্রচার চলাকালীন বোঝার চেষ্টা করছিলেন কোথায় কোথায় তিনি হারতে পারেন এবং তার পিছনে কারণ কি। আমি তার অনেকগুলো নির্বাচনী প্রচার কভার করতে গিয়েছি, প্রচারের মাঝে আমার সাথে কখনও ব্যক্তিগত কথাও হয়েছে। গোটা লোকসভা নিয়ে তিনি একটা চিত্র তৈরির কাজ তখন থেকেই শুরু করে দিয়েছিলেন সকলের অগোচরে। সেদিন আমি বুঝেছিলাম যে ফল প্রকাশের পর কিছু একটা ঘটবে, তিনি কিন্তু তৃণমূল কংগ্রেসের আগের জয়ী প্রার্থীদের মত হবেন না। এই কথা আমি কিছু ব্যক্তিগত স্তরে বলেছি। সায়নী ঘোষ কিন্তু জয়ী হলেও যেখানে হারবে সেখানে ছেড়ে কথা বলবে না।
অনেকে তখন আমার কথাটাকে খুব হালকা ভাবে নিয়েছিলেন কারণ তারা তো আগে কখনও সেভাবে দেখেন নি। এর আগে কৃষ্ণা বসু, সুগত বসু, কবীর সুমন বা মিমি চক্রবর্তী কাউকেই ফল প্রকাশের পর ময়দানে নেমে চুলচেরা বিশ্লেষণ করতে দেখা যায়নি, তাই এবারও সেটাই হবে ধরেই নিয়েছিলেন। কিন্তু এটা ভাবেন নি সায়নী ঘোষ কিন্তু তিন বছর রীতিমত সংগঠনটা করে প্রার্থী হিসাবে মনোনীত হয়েছেন। কোন সেলিব্রেটি ভাবমুর্তি নিয়ে কিন্তু প্রার্থী হন নি। অবশ্যই তিনি একজন অভিনেত্রী মানে সেলিব্রিটি কিন্তু পাশাপাশি সংগঠনটাও দেখেছেন। রাজনীতির ময়দানে তিনি একজন সভানেত্রী, তখন তিনি অভিনেত্রী নন।
ফল প্রকাশের পর তিনি বিজয় সম্মেলনীতে অংশগ্রহণ করেছেন, কর্মী সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেছেন কিন্তু পাশাপাশি রিভিউ মিটিংও করেছেন। প্রথমেই তিনি সব থেকে কম মার্জিনে যেই বিধানসভায় জয়ী হয়েছেন সেই সোনারপুর দক্ষিণে রিভিউ মিটিং করেছেন। বিধায়ক লাভ্লি মৈত্রকে পাশে নিয়ে পৌরসভা ও পঞ্চায়েত জনপ্রতিনিধিদের সাথে কথা বলেন। কিন্তু এই সভায় কিন্তু তিনি সন্তুষ্ট হতে পারেন নি। জানা যায় আবার তিনি সকলের সাথে বসবেন। খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করবেন এই কম মার্জিনের পিছনে আসল রহস্য। সূত্রের খবর এই বিধানসভায় যে মার্জিন কম হবে তা তিনি নির্বাচনের আগে থেকেই আঁচ পেয়েছিলেন। আমাদের গোপন সূত্রের খবর অনুযায়ী এই বিধানসভায় কর্মী ও নেতৃত্বদের মধ্যে তেমন কোন সু সম্পর্ক নেই অর্থাৎ নিজেদের মধ্যে বোঝাপড়ার মাঝে থেকে গেছে একটা বড় গ্যাপ। আর সেই গ্যাপের সুযোগ তুলেছেন বিরোধীরা। অনেকে এই অভিযোগ প্রকাশ্যে না বললেও হাবেভাবে বুঝিয়ে দিয়েছেন। গোপন সূত্রে জানা যায় এই বিধানসভায় এই রিভিউ মিটিং-এর আগে সকলকে বলা হয়েছে কোন মুখ না খুলতে। যদি তেমন কোন প্রশ্ন ওঠে সেখানে যেন বিধায়ককে দেখিয়ে দেওয়া হয়, যা সামলানোর তা বিধায়ক সামলাবেন। এটাই ছিল এই সভার সব থেকে বড় ত্রুটি। এমনও কানাঘুষো শোনা যাচ্ছে এমনও বলা হচ্ছে যদি সাংসদ ব্যক্তিগতভাবে কাউকে ডাকে সেখানেও যেন বিধায়কের অনুমতি ছাড়া না যাওয়া হয়।
এরপর সোনারপুর উত্তর বিধানসভায় রিভিউ মিটিং-এ বিধায়ক ফিরদৌসী বেগম ও দক্ষ সংগঠক নজরুল আলি মন্ডলের পক্ষ থেকে এরকম কোন নির্দেশ দেওয়া হয় নি, বরং এখানে সবটাই সোনারপুর উত্তর যাদের নেতৃত্বে তারা নিজেরাই কোন ওয়ার্ড কেন হেরেছে তা একেবারে সকলের সামনে পরিস্কার করে দিয়েছেন। সোনারপুর উত্তর বিধানসভায় ১নং, ৫নং, ২৮ নং, ২৯ নং, ৩১ নং ও ৩৫ নং ওয়ার্ড তৃনমূল কংগ্রেস পিছিয়ে ছিল। এই ৬টা ওয়ার্ডের মধ্যে ৫নং ও ৩৫ নং ওয়ার্ডের পৌর প্রতিনিধিদের সভার মধ্যেই নিজেদের গাফিলতি, ত্রুটি ও অন্যান্য বিশেষ করণ তুলে ধরা হয়। যদিও এই দুই প্রতিনিধি ওয়ার্ডের কিছু সমস্যার কথা সামনে তুলে নিজেদের দায় থেকে মুক্ত হওয়ার চেষ্টা করলে বিধায়ক ফিরদৌসী বেগম ও দক্ষ সংগঠক নজরুল আলি মন্ডল তা আমল দেন নি। এমনকি ওয়ার্ডে তৃনমূল কংগ্রেসের শাখা সংগঠনের দায়িত্ব যাদের উপর দেওয়া হয়েছিল সেটা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন সাংসদ সায়নী ঘোষ। তিনি ৫ নং ওয়ার্ডের ছাত্রনেতাকে নিয়ে বলেন একজন ছাত্রনেতা কিভাবে বিবাহিত হতে পারে? এটাও ওয়ার্ডের সংগঠনের গাফিলতি। এছাড়া মানুষের সাথে দুর্ব্যবহার থেকে আরও কিছু অনৈতিক কার্যকলাপের কারণে মানুষ দলের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন বলেও আলোচনায় উঠে আসে। বিধায়ক ফিরদৌসী বেগম সাফ সতর্ক করে বলেন আগামীদিনে এধরনের কোন অভিযোগ এলে তাদের নামে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ নেওয়া হবে শুধ নয়, সেই ওয়ার্ডের মানুষের সামনে তাদের ভুল স্বীকার করে নাকখত দেওয়া করাবেন। বিধায়ক ফিরদৌসী বেগম পরিস্কার বুঝিয়ে দিয়েছেন কারও দোষে যদি দল ক্ষতিগ্রস্থ হয় সেখানে কোনভাবেই রেয়াত করা হবে না। সকলকে এই ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে। বোঝাই গেল এই দুটো ওয়ার্ডের ফল ও কার্যকলাপ নিয়ে বিধায়ক খুশি নন। গোটা লোকসভা নির্বাচনী প্রচারে দলীয় প্রার্থীর সমর্থনে প্রতিটা ওয়ার্ড ও পঞ্চায়েতে দিনরাত এক করে বিধায়ক ফিরদৌসী বেগম ও রাজপুর সোনারপুর পৌরসভার সি আই সি ও সংগঠক নজরুল আলি মন্ডল লড়াই করে গেছেন যাতে দল একটা ভাল মার্জিনে জয়ী হয় আর সেখানে ব্যক্তিগত স্বার্থের কারণে দলকে পিছিয়ে থাকতে হয় তা কখনই মেনে নেওয়া উচিত হবে না। কখনও প্রার্থীকে সাথে করে আবার কখনও প্রার্থী ছাড়াই তারা দুজনে একদিকে সংগঠন দেখেছেন আবার মানুষের দরজায় দরজায় গেছেন। সায়নী ঘোষ এমনও বলেন তার নিজের একটা প্রতিনিধি দল নির্বাচনের সময় থেকে বিভিন্ন এলাকায় সার্ভে করে একটা রিপোর্ট দিয়েছে যা তিনি এই বিধানসভার সংগঠনের দায়িত্বে থাকা নেতৃত্বকে দিয়ে যাচ্ছেন। কয়েকজন পৌর প্রতিনিধিদের নামে বিশেষ কিছু অভিযোগ আছে যদি তারা নিজেদের অনৈতিক কার্যকলাপের থেকে বিরত থাকেন তবে ভাল আর নাহলে পরবর্তী সিদ্ধন্তের জন্য তৈরি থাকতে হবে। সায়নী ঘোষ আরও পরিস্কার করে বলেন এখানে DISCUSSION হবে আর এই রিপোর্ট যখন দলের সর্ব ভারতীয় সাধারণ সম্পাদকের কাছে যাবে তখন কিন্তু সেটা পরিবর্তন হয়ে DECISSION হয়ে যাবে। সুতরাং এখন সময় আছে নাহলে এই ফল ২০২৬ সালে প্রতিফলিত হলে ২০২৭ সালে নিজেদের জায়গা নিয়ে ভাবতে হবে। মানে এক কথায় বুঝিয়ে দিলেন ২০২৭ সালের পৌর নির্বাচন আর লড়তে হবে না, নির্বাসনে যেতে হবে। এই গুরুত্বপূর্ণ সভায় সকল পৌর প্রতিনিধি উপস্থিত থাকলেও ২৮ নং ওয়ার্ডের পৌরপিতা গোপাল দাস উপস্থিত না থাকায় তাকে শো-কজ করার সিদ্ধান্ত নেন সাংসদ সায়নী ঘোষ। যদিও গোপাল দাস এক পারিবারিক অনুষ্ঠানে দেশের বাইরে আছেন বলে জানা যায় কিন্তু সেটা নেতৃত্বকে জানানো তার দায়িত্বের মধ্যে পড়ে বলে মনে করা হয়।
উপরের যে প্রতিবেদন পড়লেন তারপর আপনাদের কি মনে হচ্ছে এর আগে এধরনের কোন সাংসদ দেখেছেন? এই রাজ্য থেকে তৃনমূল কংগ্রেস শুধু নয় যতজন সাংসদ হয়েছেন তার মধ্যে সর্ব কনিষ্ঠ সাংসদ এবং এরকম দক্ষতার সাথে নিজের সাংসদীয় দায়িত্ব সাথে সংগঠনের দায়িত্ব সমান ভাবে সামলাচ্ছেন। শুধু রিভিউ মিটিং নয়, এরই মধ্যে তিনি বারুইপুর পূর্ব ও পশ্চিম বিধানসভায় পঞ্চায়েত এলাকায় উন্নয়ন নিয়ে ইতিমধ্যে আলোচনা সেরে ফেলেছেন এবং বারুইপুরের কিশান মান্ডিতে কোল্ড স্টোরেজ করার সিদ্ধান্তের কথা জানিয়ে এসেছেন।