কোন এক দৈবশক্তি সারাজীবন আমাকে পথ দেখিয়েছেঃ প্রসিদ্ধ সন্তুরবাদক পন্ডিত শিবকুমার শর্মা
বিশেষ প্রতিনিধি, এবিপিতকমা, কলকাতা, ২৭শে সেপ্টেম্বর ২০২০ : “কোন এক অদৃশ্য দৈবশক্তি সারাজীবন আমাকে দিশা দেখিয়েছে, আর আমার ধ্যান জ্ঞান ছিল শুধুমাত্র সন্তুর। কোন কনসার্ট নির্বিশেষে সুর সবসময় হৃদয়ে ঢেউ তুলেছে”। শ্রী সিমেন্ট ও প্রভা খৈতান ফাউন্ডেশন এর যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত চমকপ্রদ অনুষ্ঠান ‘এক মুলাকাত বিশেষ’ এ জানালেন আশি বছর বয়স্ক প্রবীণ সন্তুরবাদক পন্ডিত শিব কুমার শর্মা। তাঁর সঙ্গে আলাপচারিতায় ছিলেন স্বনামধন্য লেখিকা, জীবনীকার তথা সাংস্কৃতিক কিউরেটর ইনা পুরী। ভারতের বিভিন্ন শহরের সঙ্গীতপ্রেমী দর্শকরা সানন্দে অংশগ্রহণ করেন এই ভার্চুয়াল অনুষ্ঠানে।
তাঁর বাবা ঊমা দত্ত শর্মা ছিলেন বেনারস ঘরানার প্রখ্যাত সঙ্গীতশিল্পী। তাঁর পরিকল্পনা অনুযায়ী সন্তুর কে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের অংশ হিসাবে যুক্ত করা হয়। যে সময় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের আঙিনায় ছিল সরোদ, বীণা ও সেতারের রাজত্ব। সন্তুর কে শাস্ত্রীয় বাদ্যযন্ত্রের মর্যাদা দিতে তিনি বিস্তর গবেষণা ও সাধনা শ্রী শর্মা করেন তা বিফলে যায়নি। স্মৃতিচারণায় জানান পন্ডিত শর্মা যাঁর সঙ্গীত জীবনের সূচনা কন্ঠশিল্পী ও তবলাবাদক হিসাবে।
পন্ডিত শিব কুমার শর্মার শিল্পনৈপুণ্যে সন্তুর শুধুমাত্র জনপ্রিয়ই হয়নি, বিশ্ববন্দিত হয়েছে। তাঁর হাত ধরেই ভারতীয় চলচ্চিত্র সঙ্গীতে সন্তুর এর ব্যবহারের সূচনা হয়। “১৯৫৫ সালে মুম্বই তে একটি কনসার্টের সময় বিখ্যাত চিত্রপরিচালক ভি সান্তারামের কন্যা মধুরা জি তাঁর বাবার সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেন। তাঁর পরিচালিত ছবি ঝনক ঝনক পায়েল বাজে চলচ্চিত্র আমি প্রথম সন্তুর বাজাই। এই বিখ্যাত শিল্পীর সুরঝঙ্কার অমর হয়ে রয়েছে সিলসিলা, লমহে, চাঁদনী, ফাসলে প্রভৃতি চলচ্চিত্রে। শিব-হরি (বংশীবাদক হরিপ্রসাদ চৌরাসিয়া)যুগলবন্দী অন্য মাত্রা এনে দিয়েছিল ভারতীয় চলচ্চিত্র সঙ্গীতে।
পন্ডিতজি আধুনিক সঙ্গীতচর্চার প্রতি যথেষ্ট উদার মনোভাব বহন করেন তবে সঙ্গীত সাধনার গুণগত মানের ক্ষেত্রে তিনি সর্বদা আপোসহীন। অন্যান্য স্বনামধন্য শিল্পী যেমন স্বর্গীয় পন্ডিত যশরাজ, হরিপ্রসাদ চৌরাসিয়া প্রমুখ বিশিষ্টজনের যথেষ্ট হৃদ্যতা রয়েছে শিবকুমারের। তার সাক্ষর পাওয়া যায় তাদের সম্মিলিত শিল্পকর্মে।
আলাপচারিতায় উঠে আসে স্বর্ণযুগের সোনালী স্মৃতি। জনপ্রিয় হিন্দী চলচ্চিত্র সিলসিলার সঙ্গীত নির্দেশনার সময় কিশোর কুমার গান গাইতে প্রথমে আপত্তি জানান, শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে যথাযথ তালিম না থাকায়। পন্ডিতজি একটি গান রেকর্ড করে তাঁকে পাঠান। সেটি শোনার পর কিশোর কুমার সিলসিলা’তে গান গাইতে সম্মত হন।
যুগের সাথে সাথে দর্শক ও তাদের প্রতিক্রিয়ার কিরকম পার্থক্য হয়েছে সে বিষয়ে পন্ডিতজি বলেন, “সমাজ ও যুগের সাথে তাল মিলিয়ে দর্শকদের মনোভাব পরিবর্তিত হয়েছে। ৫০ এর দশক অবধি দীর্ঘ সময় ধরে সন্তুর পরিবেশন করতাম কারণ শ্রোতাদের তুলনামূলকভাবে বেশী সময় ছিল এবং একইসঙ্গে টিকিটের মূল্য বেশী ব্যয়সাপেক্ষ ছিলনা। পরবর্তীকালে কাজের পরিসর ও সময় পরিবর্তনের সাথে সাথে বদলেছে সঙ্গীত পরিবেশনের সময়। মনে পড়ে একসময় যখন আমেরিকা যেতাম একটানা চারঘন্টা সন্তুর পরিবেশন করতাম। মাঝে শুধু আধঘন্টার বিরতি থাকত। কিন্তু বর্তমানে ভারতে বিভিন্ন কারণে এক একটি পরিবেশনের সময়কাল মাত্র একঘন্টা বা দেড়ঘন্টা হয়ে দাঁড়িয়েছে। গুণগত মান অক্ষুণ্ণ থাকলেও কমেছে পরিবেশনের সময়সীমা।
নবীন প্রজন্মের সন্তুর বাদকদের জন্য পন্ডিতজির বার্তা হল, কঠোর পরিশ্রম, অধ্যবসায়, মনোনিবেশ ও আত্মনিবেদনের মধ্যে লুকিয়ে আছে সাফল্যের চাবিকাঠি। পরিশ্রম ব্যতীত ভাগ্যের কোন ভূমিকা নেই আমাদের জীবন নির্ধারণে। পরিবর্তিত সময়ের কারণে বদলেছে নিয়মনীতি। মহামারীর সংক্রমণ রুখতে বিনোদন বন্দী হয়েছে ভার্চুয়াল মাধ্যমে। কিন্তু পন্ডিতজির ভাষায়, ভার্চুয়াল পারফরম্যান্সে অপূর্ণ থাকে মঞ্চ উপস্থাপনার প্রাণ ও আবেশ।
একজন সঙ্গীতশিল্পীর সাফল্যের জন্য বলিউড ইন্ডাস্ট্রির সঙ্গে যোগসূত্র থাকা বাঞ্ছনীয় কিনা সে প্রসঙ্গে পন্ডিত শর্মা বলেন এমন বহু স্বনামধন্য শিল্পী রয়েছেন যাঁরা বলিউডের সঙ্গে কখনও যুক্ত না হয়েও যথেষ্ট খ্যাতি অর্জন করেছেন।
প্রথিতযশা এই সন্তুরবাদকের বহু আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতা রয়েছে। “পুনের ওশো আশ্রমে আমি প্রায় একঘন্টা সন্তুর পরিবেশন করি। অনুষ্ঠানের শেষে কোনো করতালির শব্দ ছিলনা। আমি চোখ মেলে দেখি প্রতিটি শ্রোতা চোখ বন্ধ করে এক ধ্যানের মধ্যে আচ্ছন্ন রয়েছেন। তাঁদের ভাবের আবেশে বিঘ্ন না ঘটিয়ে আমি নিঃশব্দে মঞ্চ থেকে বেরিয়ে আসি। এমন বিরল নিঃশব্দ অভিবাদন আমায় মুগ্ধ করে।
কোভিড কবলিত দুঃসময়ের প্রসঙ্গে পন্ডিতজি বলেন অনেক অন্ধকারের মধ্যেও এইসময় আমরা যে অফুরান সময় পেয়েছি তা আত্মোপলব্ধির পক্ষে সহায়ক। এক অভূতপূর্ব পরিস্থিতির সম্মুখীন আমরা। তবে প্রকৃতি ও জীবনকে অনুধাবন করার জন্য এই দুঃসময়ের মধ্যেও লুকিয়ে ছিল কিছু সদ্বর্থক দিক।
এক মুলাকাত অনুষ্ঠানের মঞ্চ এভাবেই আলো করে চলেছেন দেশ-বিদেশেরবহু শিল্পী, পথপ্রদর্শক, সংস্কৃতিমনস্ক, সুচিন্তক ও লেখক।প্রচারে মিডিয়া শাইন।