অর্থাভাবে অত্যন্ত সাধারণ,নিন্ম মধ্যবিত্ত, পরিচিত নামকরা শিল্পী তুলসী চক্রবর্তী ছিলেন একদম নিরহংকার ঘরোয়া মানুষ
অম্বর ভট্টাচার্য, তকমা নিউজ, কলকাতা, ১১ই ডিসেম্বর ২০২৩ : চিৎপুরের এক চাটের দোকান, সন্ধ্যেবেলায় বাবুরা কষা মাংস,ঝাল-ঝোল দিয়ে মৌতাত করে সেখানে প্লেট ধোয়ার কাজ নিয়েছিলেন। জ্যাঠামশাইয়ের অন্ন ধ্বংস করবেন না স্বাবলম্বী হতে হবে এই ছিল মনের অভিপ্রায়।জ্যাঠামশাইয়ের কানে খবর যেতেই মাথার চুল ধরে হিড় হিড় করে টানতে টানতে নিয়ে গিয়ে বলেছিলেন ব্যাটা স্বাবলম্বী হতে চাইছো? চাটের দোকান থেকে ছাড়িয়ে আনা হলেও বাড়ি থেকে পালিয়ে চলে গেলেন বার্মায় বাঙালির বোসেস সার্কাসে। সেখানে শিখে গিয়েছিলেন অনর্গল উর্দু আর হিন্দিতে কথা বলা৷ সার্কাসে অবশ্য বেশিরভাগ সময় জোকার সাজতে হত । তিনি কিংবদন্তি অভিনেতা তুলসী চক্রবর্তী।
নিজে বিরাট মাপের অভিনেতা, কোনও দিন বুঝতে চাইতেন না,বিনয়ের সঙ্গে বলতেন ওরে বাবা আমি আবার অভিনেতা হলাম কবে!নিজের যা বিদ্যেবুদ্ধি তাতে অন্য কিছু করে অন্ন জুটবে না।তাই পেটের দায়ে থিয়েটার -বাইশকোপে পেছন নাচাই।একে কি অভিনয় বলে! সার্কাসের চাকরি ছেড়ে বাড়ি ফিরলে জ্যাঠামশাই তুলসীকে ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন চিৎপুরের এক ছাপাখানায় ,সত্যি বলতে কি ওই ছাপাখানায় কাজ করতে গিয়ে তুলসী চক্রবর্তীর মনে অভিনেতা হওয়ার বাসনা উদগ্র হয়ে উঠতে লাগল৷ হ্যাণ্ডবিলে নানা বিজ্ঞাপন পড়তে পড়তে মনে হত অভিনেতা হলে তাঁর তো এইরকম পোস্টারে নাম ছাপা হবে৷ সেই তুলসী চক্রবর্তী সত্যজিৎ রায়ের ‘পরশপাথর’-এর সময় শহরের রাস্তায় বড় বড় পোস্টার দেখে নিজেই বলেছিলেন, ‘এ আমি কি হনু হয়ে গেলাম!’
জ্যাঠামশাইয়ের কাছে ভাইপো বায়না ধরলেন তাঁকে থিয়েটারে ঢুকিয়ে দিতে হবে, আবদারটা মন্দ লাগেনি প্রসাদ চক্রবর্তীর,নিজের মুখে তুলসী কে বলেছিলেন ‘সেই ভালো তোর তো দেখছি অ্যাকটিংটা ভালোই আসে,তাছাড়া সবসময় চোখের কাছে থাকতে পারবি’৷ অপরেশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের কাছে কাকুতি মিনতি করে জ্যাঠামশাই ভাইপো কে স্টার থিয়েটারে ঢুকিয়ে দেন। অর্কেস্ট্রার দলে থাকতে থাকতে গান আর অভিনয়ের নেশা ধরেছিল বালক তুলসী’র, শৈশবে নানা আসরে গান গাইতেন,পরবর্তীকালে অন্যান্য দলে এসব করেছেন,কিছুটা নাচ শিখতে হয়েছে সেখানে শিক্ষার ভুল হলে খেজুর ডালের ছড়ির মার পরেছে পায়ে।
থিয়েটারে তুলসী চক্রবর্তীর অভিনয়ের হাতে খড়ি,’দূর্গেশনন্দিনী’ নাটকে,সে ঘটনা ১৯২০সালের। আর শেষও স্টার থিয়েটারে ‘শ্রেয়সী’নাটকে। সিনেমা জীবন শুরু থিয়েটারে অভিনয়ের বারো বছর পরে সাহিত্যিক প্রেমাঙ্কুর আতর্থীর ‘পুনর্জন্ম’ ছবিতে ছোট্ট ভূমিকায় অভিনয় করে রূপালী পর্দায় আত্মপ্রকাশ।এরপর একের পর এক ছবিতে অভিনয়ের সুযোগ আসতে থাকে।
তুলসী চক্রবর্তী অভিনীত ‘সাড়ে চুয়াত্তর’ বাংলা সিনেমা প্রেমীদের কাছে একটা আবেগের নাম,একটা মাইলস্টোন৷ রাজলক্ষ্মী দেবীর সঙ্গেও তুলসী চক্রবর্তী জুটি কম নয়৷ একটা ছোট্ট উদাহরণ, একটু ফ্লাশব্যাকে যেতেই হবে, ‘হাসি শুধু হাসি নয়’ ছবিটির কথা মনে করে নিতে পারেন৷ পর্দায় তুলসীর চরিত্রের অনেক অর্থবিত্ত আছে,আট মেয়ের বিয়েতে দশ দশ করে আশি হাজার টাকা খরচ করেছেন, তবু স্ত্রী’র হৃদয় জিততে পারেনি৷ রাত বিরেতে মদ গিলে মুখে গন্ধ নিয়ে রোজ বাড়ি ফেরেন। ‘ধিঙ্গি’ মেয়েদের নিয়ে হুল্লোড় করেন বলে তুলসীর রোজগার করা টাকার মুখে ঝাঁটা মারেন স্ত্রী৷ ৩০ বছর একসাথে সংসার করেও সেখান থেকে মুক্তি পেতে উকিলের চেম্বারে ডিভোর্স করতে ছুটে আসেন পর্দার তুলসী-রাজলক্ষ্মী। —ডিভোর্স চাই, ডিভোর্স চাই, ডিভোর্স চাই…অনবদ্য অভিনয়ে দুজনে মাত করেছেন৷
সত্যজিৎ রায়ের ‘পরশপাথর’ আর তুলসী চক্রবর্তী মানুষের ভালবাসায় কবেই যেন বঙ্গ সংস্কৃতির অঙ্গ হয়েছে। তুলসী চক্রবর্তীর অভিনয়ে মুগ্ধ বাংলার আবালবৃদ্ধ বনিতা, কেউ হয়ত জিজ্ঞেস করেছেন এমন অসাধারণ অভিনয়ের রহস্য কি? বিনয়ের সঙ্গে উত্তর দিতেন এইসব চরিত্রে অভিনয় করতে গেলে আবার অভিনয় করতে হয় নাকি, এইতো চারপাশে সবাই ঘুরে বেড়াচ্ছে শুধু এদেরকে তুলে এনে নিজের কাঁধে ভর করাও৷ মানিক বাবু বিশ্বাস করতেন, তুলসী চক্রবর্তী ভারতের মরিস শিভ্যালিয়র। ছবি বিশ্বাস আর এক কদম এগিয়ে বলেছিলেন,’বিদেশে জন্মালে তুলসী চক্রবর্তী একটা অস্কার পেতেনই।’
কিংবদন্তি অভিনেতা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় তুলসী চক্রবর্তী সম্পর্কে একসময়ে শ্রদ্ধার সঙ্গে লিখেছিলেন ‘স্কুলে পড়ার সময় বেশ কয়েক বছর আমি হাওড়ায় থেকেছি,সেইসময় কালীবাবুর বাজারে বাজার করতে গেলেই দেখতে পেতাম তুলসীবাবু থলে হাতে বাজার করছেন ৷ পরনে অত্যন্ত সাধারণ,নিন্ম মধ্যবিত্তের মত আধময়লা ধুতি,গায়ে একটা ব্যবহারে জীর্ণ ফতুয়া কি গেঞ্জি’৷ তুলসী চক্রবর্তী, সবজীওয়ালা,মাছওয়ালার সঙ্গে বন্ধুর মত গল্প করছেন ৷ অথচ চল্লিশের দশকের শেষে তিনি সিনেমার অতি পরিচিত নামকরা শিল্পী৷ অথচ একদম নিরহংকার ঘরোয়া মানুষ ৷ প্রাণপাত পরিশ্রম, অসম্ভব নিষ্ঠা,আর আবেগ দিয়েই পর্দায় জীবন্ত করে তুলেতে পারতেন যেকোনও চরিত্রকে৷
স্বামী-স্ত্রী দু’জন মানুষের সংসার তবু ছিল অর্থকষ্ট ৷ কম পারিশ্রমিক নিতেন হয়ত সেজন্য অর্থ জোগাড়ে মাঝে মধ্যে পুরোহিতের কাজ করেছেন৷ শেষ জীবনেও অর্থ কষ্টে ভুগেছেন, চিকিৎসার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থের অভাব হয়েছে৷ ১১ই ডিসেম্বর ১৯৬১ সালে অভিনেতা তুলসী চক্রবর্তীর প্রয়াণ দিবসে আমাদের শ্রদ্ধাঞ্জলি। ৩রা মার্চ ১৮৯৯ ছিল তুলসী চক্রবর্তীর জন্মদিন।