বাংলা ও বাঙালির গৌরবের মুখরোচকের ৭০ বছর পূর্তী সায়ন্স সিটিতে, সাফল্যের মুখরোচক ইতিহাসটা জানলে চমকে উঠতে হবে
অম্বর ভট্টাচার্য, এবিপিতকমা, কলকাতা, ৭ই জানুয়ারি ২০২০ : পঞ্চানন চন্দ্র একসময় সংসারের দায়ে ভবানী সিনেমার পাশের গলিতে বাঙাল পাড়ার বাসিন্দা একটা ছোট সোনা রূপার দোকান করেন। কিন্তু এক বন্ধুর বিশ্বাসঘাতকতার কারণে সংসারে নেমে আসে বিপত্তি। ১৯৫০ সাল টালিগঞ্জের এক জ্যোতিষীর উপদেশে টালিগঞ্জ ট্রামডিপোর কাছে ভাড়ায় একটা ছোট্ট দোকান দিয়ে পুত্র নির্মলেন্দু চন্দ্রের নামে সেই যাত্রা শুরু।১৫ বছরের পুত্র নির্মলেন্দু চন্দ্রের পড়াশুনোর ইতি সেই সময়। সংসারের অর্থের সংস্থানের জন্য শুরু হল অর্থ সংস্থানের যুদ্ধ। দৈনিক এক টাকা ভাড়া কিন্তু চানাচুর কে খাবে? প্রশ্ন উঠেছিল পরিবারের সকলের মনে কিন্তু এছাড়া কোন উপায়ও ছিল না। সেই সময় রাস্তায় রাস্তায় দেখা যেত হরিদাসের বুলবুল ভাজা, টাটকা তাজা, খেতে মজা।নির্মলেন্দু চন্দ্র দেখলেন বাজারে সেই সময় মানুষ চানাচুর বলতে জানতো ডালমুট ও সেই বুলবুল ভাজা।কিন্তু ফুলুরি ভাজার পর যে বেসনের ঝুরি অবশিষ্ট থাকতো তাকে চানাচুরে মেশানোতে স্বাদ বদলালো। এবার সেই তৈরি হল পাপড়ি আর এই পাপড়ির সাথে মিশে গেল ডালমুট, বাদাম ও মশলা। স্বাদটাও একেবারে বদলে গেল। দোকানের জন্য কেনা হল কাঁচের বয়াম। দোকানের পিছনেই তৈরি করা হল কারখানা। ক্রেতারা এসে হাতে গরম চানাচুর কিনতে শুরু করল।সেই থেকেই বাড়তে থাকল চাহিদা।এবার ঠোঙায় চানাচুর দেওয়ার কাজ। এবার জনপ্রিয়াতার সাথে সাথে খুচরো বিক্রির সাথে শুরু হল গোটা কলকাতায় বিভিন্ন দোকানে চানাচুর ডেলিভারি দেওয়ার কাজ।সম্পূর্ণ কাজটা নির্মলেন্দু চন্দ্র নিজেই করতেন। তখন থেকেই এক সাহিত্যিকের কথায় চানাচুরের নামকরণ হল “মুখরোচক”। কিন্তু স্বাদ বাড়ানোর জন্য যখন নির্মলেন্দু চন্দ্র ভাবছেন তখন দিল্লিতে এক হোটেলে খেতে গিয়ে নিরামিষ খাবারে আমিষের স্বাদ তাঁর জীবনের মোড় দিল ঘুড়িয়ে। সেই হোটেলের রন্ধনশালার প্রধানের পরামর্শে মশলা দিতেই এনে দিল মুখরোচকের ৭০ বছরের সাফল্য। কথাগুলো সেই পরিবারের বর্তমান প্রজন্ম প্রণব চন্দ্র মঞ্চে দাঁড়িয়ে সকলের উদ্দেশ্যে বলছিলেন সংস্থার গর্বের ৭০ বছরের পূর্তীতে। এখানেই শেষ নয়, এরপর ট্রামডিপো থেকে কারখানা নতুন ঠিকানা হল ইন্দ্রপুরী স্টুডিও-র পার্শবর্তী গ্রাহাম রোডে। সেই সময় অভিনয় জগতের বহু দিকপাল অভিনেতা-অভিনেত্রীরা টালিগঞ্জের সেই ছোট্ট দোকানে এসে “মুখরোচক” চানাচুরের স্বাদ নিতেন।গ্রাহামস ল্যান্ডে আজকের বাপ্পি লাহিড়ির বাবা অপরেশ লাহিড়ি ও বাসবী লাহিড়ি থাকতেন। প্রায়ই আসতেন দোকানে।
আসতেন মান্না দে, হেমন্ত মুখার্জি। মাঝেমধ্যে হেমন্ত মুখার্জি আর্জি হত দ্রুত প্যাক করে দিতে হবে চানাচুর, নিয়ে যাবেন লতা মঙ্গেশকরের জন্য। আসতেন নচিকেতা ঘোষ, গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার, উৎপল দত্ত মেজাজ ফেরাতে লোক পাঠাতেন চানাচুর কিনতে। সত্যজিৎ রায়ের জন্য এই চানাচুর কিনে নিয়ে যেতেন তপেন চ্যাটার্জি। একদিন সাদা অ্যাম্বাসাডার গাড়ি নম্বর ডাবলু এম সি- ৮৭৮৭ এসে দাঁড়ালো দোকানের সামনে, পিছনের সিটে গাড়ির মালিক আর দোকানে আসলো ড্রাইভার। তিনি ছিলেন মহানায়ক উত্তম কুমার। ১৯৭০ সাল বাধ সাধল সেই সময়ের রাজনৈতিক জটিলতা। বাধ্য হয়ে নির্মলেন্দু চন্দ্র সব ছেড়ে দিয়ে চলে এলেন সেই সময়ের ডাকিনীতলায় যা আজকের লাঙলবেড়িয়া। সেই সময় এই গ্রামে বেশ কিছু তান্ত্রিক সাধনা করত, এখানে বহু মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষ আসতো মনস্কামনা পূর্ণ করতে। বাড়ির মালিক গোপাল মজুমদার ডাকাতের ভয়ে তাঁর ইট আর মাটির কাছারিবাড়ি ছেড়ে পালাতে পারলে বাঁচেন আর সেই সময় কলকাতার অশান্ত পরিবেশ থেকে মুক্তি পেতে নির্মলেন্দু চন্দ্র খুঁজছিলেন এরকমই একটা আস্তানা। ফের মুখরোচকের ঠিকানা বদল হল। পরিবার, ব্যবসা সবের পাততাড়ি গুটিয়ে চলে এলেন এখানে। ধীরে ধীরে তৈরি হল মাটির বাড়ি থেকে পাকা দালান, বাগান।
আজ সেই বাগানের প্রাকৃতিক গন্ধের সাথে মিশে গেছে চানাচুরের মশলার গন্ধ।কথাগুলো সাম্প্রতিক সংস্থার ৭০ বছর পূর্তী অনুষ্ঠানে একান্ত ব্যক্তিগতভাবে বলছিলেন প্রণব চন্দ্র।প্রণব চন্দ্রের সাধের বাগানে ফুলের ভান্ডার দেখলে মাথা ঘুরে যাবে।প্রতিদিন ভোর ৪টের সময় উঠে পরিচর্চা করেন। তিনি পড়াশুনো করেছেন বাড়ির পাসেই লাঙলবেড়িয়া সুরথ স্মৃতি বিদ্যামন্দিরে আর কলেজ আসতে ৬ কিমি সাইকেল চালিয়ে আসতে হত মল্লিকপুর স্টেশনে, সেখান থেকে বালিগঞ্জে নেমে গোলপার্ক পর্যন্ত হেঁটে। এত সংগ্রামের মধ্যেও হারিয়ে যায় নি তাঁর নির্মল ও সারল্য হাসিটা।এই হাসিটা তিনি দেখতে চান সকল চানাচুর রসিকদের মুখে।তাঁর স্বপ্ন ছিল বিদেশেও এই চানাচুরের প্রচার করবেন, আজ আন্তর্জাতিক বাজারেও “মুখরোচক” জনপ্রিয়। এদিনের ৭০ বছর পূর্তীতে লাঙলবেড়িয়ার সেই কারখানায় উপস্থিত ছিলেন সাংবাদিক অনিলাভ চ্যাটার্জি, ক্রিকেটার সম্বরণ ব্যানার্জি, জগন্নাথ বসু, উর্মিমালা বসু, পরিচালক ও প্রযোজক শিবপ্রসাদ মুখার্জি এবং অভিনেতা বিশ্বনাথ বসু। সমগ্র অনুষ্ঠানের দায়িত্বে ছিলেন বাচিকশিল্পী অতিজনপ্রিয় মীর। অনুষ্ঠানের শুরুতে আনন্দঘরের কচিকাঁচাদের সঙ্গীত পরিবেশন করে।
তারপর সকলের মুখরোচক স্মৃতিচারণ এবং সবশেষ ছিল শ্রীজাত ব্যানার্জি রচিত, জয় সরকার সুরারোপিত এবং নচিকেতা চক্রবর্তীর কন্ঠে গাওয়া “মুখরোচক” থীম সং-এর সূচনা এবং অনীলাভ চ্যাটার্জি রচিত “গল্পটা মুখরোচক” বইয়ের মলাট উন্মোচন। যদিও মীর তাঁর ঘোষণা অনুযায়ী জানান তাদের এফ এম থেকে একটা ভিডিও অ্যালবামও প্রকাশিত হবে এই মুখরোচক থীম সং নিয়ে।আর সব শেষ ঘোষণা ১৮ই জানুয়ারি সায়েন্স সিটি অডিটোরিয়ামে থাকছে মুখরোচক অনুষ্ঠান।সতিই বাঙালি ও বাংলার ব্যবসার গর্ব ও গৌরব মুখরোচক যেখানে আজ কর্মীরা প্রার্থনা সেড়ে তবে কাজ শুরু করে। তাদের প্রার্থনা স্বাদ ও গন্ধ যেন সর্বদাই অটুট থাকে ক্রেতাদের কাছে, সকলে যেন সুস্থ্য থাকেন কারণ মুখরোচক কখনই তার মানে আপোষ করে না।বর্তমানে এই ঐতিহ্যের ব্যাটন নতুন প্রজন্ম অভিক চন্দ্রের হাতে। প্রচারে কারপেডিয়াম।