মন্ত্রীত্ব খোয়ালেন পার্থ, কিন্তু প্রশ্ন এত টাকা কি সবটাই শিক্ষক নিয়োগের? নাকি নির্বাচনের টিকিটের টাকা?
অম্বর ভট্টাচার্য, তকমা নিউজ, কলকাতা, ২৮শে জুলাই ২০২২ : ২২শে জুলাই একদিকে পার্থ চ্যাটার্জি-র নাকতলার বাড়িতে হাজির হয় ইডি অন্যদিকে ইডি-র আরেকটা দল পৌঁছায় হরিদেবপুরের ডায়মন্ড সিটি সাউথে পার্থ ঘনিষ্ট অর্পিতা মুখার্জির ফ্ল্যাটে। এরপর থেকেই রাজ্যের চিত্রটা বদলাতে শুরু করে দিল। ইডি দুজনকে নিজেদের হেফাজতে নিয়ে আদালত থেকে অনুমতি নিয়ে তদন্তের গভীরে প্রবেশ করে। তার আগেই পার্থ চ্যাটার্জির বাড়ি থেকে বেশ কিছু নথি ও অর্পিতার ফ্ল্যাট থেকে ২২ কোটি টাকা, বিদেশি মুদ্রা, সোনা, সম্পত্তির দলিলের হদিশ পায়। ২৭শে জুলাই অর্পিতার বেলঘড়িয়ার ফ্ল্যাটে গিয়ে ২৮ কোটি টাকা, তাল তাল সোনা ও আরও দলিলের সন্ধান পায়। এখানেই শেষ নয়, একাধিক বান্ধবীর সন্ধানও পায় ইডি তদন্ত দল যেখানে অনিয়মের ভিত্তিতে চাকরিতে রাখা হয়েছে তাদের। এখন যদিও অর্পিতাই মূল টার্গেট পরে আবার বাকিদের নিয়ে অনুসন্ধান চলবে।
এতকিছু বাইরে আসতেই মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি দিশাহারা হয়ে পড়েন। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গিয়ে তিনি পার্থ সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে বিভিন্ন মন্তব্য করতে শুরু করে দেন। তিনি সাফ জানান অর্পিতা কোনদিনও তৃনমূল দলটা করেনি। কিন্তু উদয়ন সংঘের দুর্গাপুজোয় গিয়ে ভূয়সী প্রসংসা করেন। এদিকে তৃনমূল দলের মধ্যে পার্থ-র বিরুদ্ধে পুরানো ব্যাথা নিয়ে মুখ খোলেন দলের মুখপত্র কুনাল ঘোষ। তিনি সাফ টুইট করে জানান পার্থকে অবিলম্বে মন্ত্রীত্ব ও সব পদ থেকে সরানো উচিত, যদি দল মনে করে তবে তাকে দল থেকে বহিষ্কার করতে পারে, একজন সাধারণ দলীয় কর্মী হয়ে থাকবেন। এরপরই পার্থ চ্যাটার্জিকে মন্ত্রীত্ব ও সব পদ থেকে সরিয়ে দিল দল ও সরকার।
কিন্তু রহস্যের শেষ হল না। ইডি বলছে এত টাকা ও এত টাকার সম্পত্তি সবটাই প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগের টাকা দিয়ে হয়েছে। সন্দেহটা এখানেই। শোনা গেছে বেআইনি শিক্ষক নিয়োগের জন্য প্রতি প্রার্থী পিছু ১৫ লাখ থেকে ২০ লাখ টাকা নেওয়া হয়েছে। তবে কি সব টাকাটা পার্থ চ্যাটার্জি একাই নিয়েছেন? আরা প্রার্থী খোঁজার দায়িত্বে ছিলেন তারা কি খালি হাতে কাজ করেছেন? না গোটা রাজ্যে তৃনমূলের বিভিন্ন সংগঠনের নেতৃত্বরা এই কাজে লিপ্ত ছিলেন। তারা আবার তাদের নিচু তলার নেতাদের, তারা আবার তাদের নিচু তলার কর্মীদের কাজে লাগিয়েছিলেন প্রার্থী খোঁজার কাজে। এখান থেকে পরিস্কার সব কেটে ছেঁটে পার্থ চ্যাটার্জির হাতে যখন প্রার্থী তালিকার সাথে টাকা গেছে তখন সেই অঙ্কটা প্রতি প্রার্থী পিছু ১০ লাখ টাকা। এবার প্রশ্ন? কত বেআইনি প্রার্থীর সুপারিশ হয়েছে, ধরে নেওয়া যাক প্রায় ১০০০-এর কাছাকাছি। তাতে তো এত টাকা হচ্ছে না। তবে বাকি টাকার হিসাব কি?
দলের মধ্যে অনেকের এবার ধারণা এই বিশাল অঙ্কের টাকা বিধানসভা ও পৌরসভা নির্বাচনে টিকিট বন্টনের টাকা। বাজারে শোনা যায় বিধানসভা নির্বাচনে নতুন প্রার্থীদের প্রায় ৩ কোটি টাকার বিনিময়ে টিকিট পেতে হয়েছে। এবার সেই পুরানো প্রশ্ন, সবটাই কি পার্থ চ্যাটার্জি নিয়েছে? উত্তর সেই আবার না। এর মাঝে যিনি বা যারা টিকিট নির্দিষ্ট করে দেওয়ার দায়িত্ব নিয়েছেন তারা কাটমানি রেখেছে। সবশেষে হয়তো পার্থ চ্যাটার্জির হাতে গেছে ১ কোটি টাকা। এভাবে গোটা রাজ্যে যদি ২০ জনকে টিকিট করে দেওয়া হয় তবেই তো ২০ কোটি টাকা হয়ে গেল। এবার দেখার বিষয় ক’জন নতুন টিকিট পেয়েছে। সংখ্যাটা সেক্ষেত্রে অনেক বেশি, তাহলে টাকার পরিমাণটাও অনেক বেশি।
এরপর ছিল পৌরসভা নির্বাচন, সেখানেও একই ভাবে টিকিট বন্টন হয়েছে। বিভিন্ন বিধায়ক, জেলা সভাপতিদের সুপারিশে অযোগ্য ব্যক্তিরা টাকার বিনিময়ে টিকিট পেয়েছে। তারাও জানে এখন টাকা লাগছে ঠিক আছে, দেওয়া যাবে। হাতে ৫ বছর সময় আছে, কাঁচিয়ে কুঁচিয়ে ১০ গুণ তুলে নেওয়ার সময় আছে। বাজারে শোনা যায় এক একজন প্রার্থী তাদের টিকিটের জন্য ৩০ থেকে ৪০ লাখ টাকা দিয়েছে উচ্চ নেতৃত্বের কাছে। তারাই জয়ের পর অনেকের কাছে বলেছে। এবার টিকিটের দায়িত্বে ছিলেন পার্থ চ্যাটার্জি। নেত্রী মমতা ব্যানার্জি ঘোষণা করেছিলেন পৌরসভার মূল তালিকায় পার্থ চ্যাটার্জি ও সুব্রত বক্সি-র সই থাকবে। তবে সেই তালিকাটা কত বড় ভেবে দেখুন একবার। আমার জানা চন্দননগর পৌরনিগমের এক পৌরপিতা আমাদের সাক্ষাৎকার দেওয়ার আগে মৌখিক জানিয়েছিলেন এই পৌরনিগমে সব নতুন প্রার্থীকে টাকা দিতে হয়েছে (প্রমাণ চাইলে দেওয়া সম্ভব নয়, কারণ তিনি তো বলেছেন বলে স্বীকার করবেন না)। তবে এটা বাস্তব ঘটনা। তবে গোটা রাজ্যে ১২০ টা পৌরসভা, কত প্রার্থী হতে পারে? তার সাথে মেলান কত টাকা হতে পারে। এই কথা বলার কারণ একটাই, ২০১২ সালে শিক্ষক নিয়োগের পরীক্ষা হয়েছে যার ফল প্রকাশ হয়েছে সম্ববত ২০১৩ সালে, ২০১৪ সালে শিক্ষক নিয়োগের পরীক্ষা হয়েছে যার ফল প্রকাশ হয়েছে সম্ববত ২০১৬ সালে আর ২০১৭ সালের শিক্ষক নিয়োগের পরীক্ষা হয়েছে যার ফল প্রকাশ হয়েছে ২০২১ সালে তাও তা আদালতে মামলায় আটকে আছে। তখন তো ২০০০ টাকার নোট বাজারে আসে নি। এবার বলবেন মনিটাইজেশনের সময় বদলে নিয়েছে। এটাও একেবারে ফেলে দেওয়া যাবে না। কিন্তু তাতে এই বিশাল অর্থ মেলানো যাচ্ছে না। তাহলে এখানে টেট, বিধানসভা ও পৌরসভা সব মিলিয়ে কেলেঙ্কারি হয়েছে কিনা সেটা জেরার মুখা একমাত্র মুখ হলেন পার্থ চ্যাটার্জি আর অর্পিতা হল তার টাকার ভল্ট যেখানে পার্থ সব বিশ্বাস করে গচ্ছিত রাখতো। ইডি-র জেরার মুখে সেই বিশ্বাসেও অনেকটা দাগ লেগেছে। এই সব টাকার হদিস করতে গেলে ইডি ও তৃনমূল দলের রাতের ঘুম উড়ে যাবে।
অভিষেক ব্যানার্জি-র নেতৃত্বে তৃনমূলের শৃঙ্খলা রক্ষা কমিটির সিদ্ধান্তে পার্থ চ্যাটার্জিকে দলের মোট ৫টা পদ থেকে অপসরণ করা হল। বাংলার মানুষের কাছে তৃনমূল দল ও মমতা ব্যানার্জি বুঝিয়ে দিল কোন অনৈতিক কাজের জন্য দল ও নেত্রী সমর্থন করে না। তা সে দলের দ্বিতীয় ব্যক্তি হতে পারে।