করোনা দুর্জোগের মধ্যে অভিনয় জগতে কালো ছায়া, মানতে পারছে না সায়ন্তনী, দেবরাজ, চলে গেলেন কিংবদন্তী অভিনেতা ইরফান খান
অম্বর ভট্টাচার্য, এবিপিতকমা, কলকাতা, ২৯শে এপ্রিল ২০২০ : ইরফান খান, ৭ই জানুয়ারি ১৯৬৭ রাজস্থানে জয়পুরের টং জেলার খাজুরিয়া গ্রামে জন্মগ্রহন করেন। হিন্দি সিনেমা ছাড়াও ইরফান খান তাঁর ৩০ বছরের অভিনয় জীবনে ব্রিটিশ ও মার্কিন ছবিতেও কাজ করেছেন।প্রায় ৫০টির উপর ভারতীয় ছবিতে অভিনয় করেছেন ইরফান খান। ২০১১ সালে তিনি পদ্মশ্রী পুরস্কার লাভ করেন। কিন্তু করোনা বিপর্জয়ের মধ্যে ভারতীয় সিনেমায় নেমে এল কালো ছায়া। লকডাউনের মধ্যেই মুম্বইয়ের কোকিলাবেন হাসপাতালে আজ শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন আজ ৫৩ বছরের ইরফান খান।দীর্ঘদিন ধরে (২০১৮) নিউরো অ্যান্ডোক্রিন টিউমারজনিত রোগে ভুগছিলেন ইরফান খান।এটি একটা খুবই বিরল জাতীয় ক্যানসার, এন্ডোক্রাইন টিউমার।গতকাল রাতে তিনি খুব গুরুতর অবস্থায় মুম্বাইয়ের কোকিলাবেন ধিরুভাই আম্বানি হাসপাতালে ভর্তি হন এবং অবস্থা সঙ্কটজনক হওয়ায় আইসিইউতে ভর্তি ছিলেন তিনি।ইরফানের বিবাহ হয় ১৯৯৫ সালে বর্তমানে রেখে গেলেন স্ত্রী সুতপা শিকদার এবং দুই ছেলেকে।মাত্র চার দিন আগে (২৫শে এপ্রিল) তাঁর জয়পুরে তাঁর মা সইদা বেগম মারা যান।শারীরিক অবস্থা ভাল না থাকার ফলে তিনি সেখানে পৌঁছতে পারেননি। তিনি চিকিৎসার জন্য ইংল্যান্ডে গিয়ে অস্ত্রোপচার করে গত বছর এপ্রিল মাসে ভারতে ফেরেন ইরফান খান। তাঁর অভিনীত আগামী ছবি ‘আংরেজি মিডিয়াম’ করোনা ভাইরাসের লকডাউনের কারণে মুক্তি পায়নি।
ইরফান খান ও সতীশ শর্মা খুব ভাল বন্ধু ছিলেন এবং খুব ভাল ক্রিকেট খেলতেন। একসময় তিনি সি কে নাউডু ক্রিকেট টুর্নামেন্টে নির্বাচিত হয়েও অর্থের অভাবে খেলতে পারেন নি। অবশেষে দিল্লি থেকে ন্যাশনাল স্কুল অফ ড্রামায় এম এ পাস করেন ইরফান খান। এরপর তিনি মুম্বাই-তে এসে টেলিভিশনে অভিনয় শুরু করেন। চানক্য, ভারত এক খোঁজ, সারে জাহা হামারা, বানেগি আপনি বাত, চন্দ্রকান্ত, শ্রীকান্ত, স্টার বেস্টসেলার, ডরের মত জনপ্রিয় সিরিয়ালে অভিনয় করেন।
১৯৮৮ সালে ইরফান খানের হিন্দি সিনেমায় প্রথম আত্মপ্রকাশ ঘটে, ছবির নাম “সালাম বম্বে”কিন্তু শেষ পর্জন্ত তাঁর ভূমিকা ছবিতে ছিল না।এরপর ১৯৮৯ বাসু চ্যাটার্জি নির্দেশিত “কমলা কি মৌত” ছবিতে রূপা গাঙ্গুলির বিপরীতে অভিনয় করেন। এছাড়া বহু ছোটখাটো ছবিতে সে সময় অভিনয় করেছেন ইরফান খান।১৯৯০ সালে “এক ডক্টর কি মৌত” ছবিতে অভিনয় করেন এবং ১৯৯৮ সালে “সাচ এ লং জার্নি” ছবিতেও অভিনয় করেন। ২০০১ সালে লন্ডনবাসী নির্দেশক আসিফ কাপাডিয়ার হাত ছবে অভিনয় করেন “দ্য ওয়ারিয়র”। এই ছবি আন্তর্জাতিক চলচিত্র উৎসবে জায়গা করে নেয় এবং ইরফানকে বিশ্বের দরবারে পরিচিতি দেয়। ২০০৩ সালে “রোড টু লাদাখ”, “মকবুল” ছবিতে অভিনয় করেন। ২০০৫ সালে প্রথম মুখ্য ভুমিকায় দেখা যায় ইরফান খানকে, ছবির নাম “রোগ”। হাসিল ছবির জন্য ২০০৪ সালে ফিল্মফেয়ার সেরা খলনায়কের পুরস্কার লাভ করেন। তেলেগু ছবি “সাইনিকুডু”-তেও অভিনয় করেন ইরফান। তাবুর সাথে “নেমসেক” ছবিতেও কাজ করেছেন। ২০০৮ সালে বিখ্যাত ছবি “স্লামডগ মিলিনেয়ার” ছবিতে পুলিশ অফিসারের ভুমিকায় অভিনয় করেন।২০০৯ সালে অ্যাসিড ফ্যাক্টরি, নিউ ইয়র্ক, আই লাভ ইউ, পান সিং তোমার ছবিতে অভিনয় করেন।২০১০ সালে এইচ বি ও সিরিজে “ইন ট্রিটমেন্ট”-এ অভিনয় করেন। ২০১২ সালে দ্য অ্যামেজিং স্পাইডার ম্যান (The Amazing Spider-Man), লাইফ অফ পি ( Life of Pi), ২০১৩ সালে তাঁর অভিনীত লাঞ্চ বক্স (lunch Box) কান ফেস্টিভেলে গ্রান্ড রেল ডোর (Grand Rail d’Or) পুরস্কার লাভ করে। ২০১৫ সালে গুন্ডে, দ্য এক্সপোজ, হায়দার ছবিতেও দেখা যায়। একই বছরে পিকু ও জুরাসিক পার্ক, তালওয়ার, জাসবা ছবিতে অভিনয় করেন ইরফান। আমেরিকান নির্দেশক টম হ্যাঙ্কসের ছবি “ইনফারনো”-তেও (Inferno) অভিনয় করেন ইরফান। ২০১৭ সালে মুক্তি পায় হিন্দি মিডিয়াম ও করীব করীব সিঙ্গল। এই বছরই ইরফান ফিল্ম ফেয়ার সেরা অভিনেতা পুরস্কার লাভ করেন। ২০১৮ সালে ইরফান অভিনীত কারবান, এবং ব্ল্যাকমেল মুক্তি পায়।২০২০ সালে ইরফানের সিনেমা ছিল ‘আংরেজি মিডিয়াম’ যা মুক্তি পাওয়ার কথা ছিল ২০শে মার্চ। যদিও করোনার জেরে এক সপ্তাহও হলে টেকেনি এই সিনেমা।
ইরফানের প্রয়াণে টলিউডের অনেক নায়ক-নায়িকারা বেশ ভাঙে পড়েছেন।অনেকে তাঁকে চোখে দেখেন নি, তাঁর সাথে অভিনয় তো অনেক দূরে।আমাদের ফোনে অভিনেতা দেবরাজ মুখার্জি জানান, আমার তাঁকে সামনে থেকে দেখার সুযোগ না হলেও বলবো উনি শিখিয়েছেন কিভাবে কেন্দ্রীয় চরিত্র না হয়েও নিজের সততা ও একাগ্রতা সাথে অভিনয়ের মধ্যে দিয়ে সবার সম জয় করা যায়। আজ সেই শিক্ষা মাঝ পথে থেমে গেল। আমার মত হাজার হাজার চরিত্র অভিনেতা যারা রূপ বেঁচে খায় না, যারা প্রযোজক বা নির্দেশকের কেউ হয় না তাঁরা আজ অনাথ হয়ে গেল। অভিনেত্রী সায়ন্তিনী বলেন, কি বলবো, এই প্রথম একজন যাকে চোখে না দেখেও চোখ আজ জলে ভাসছে। তাঁর মত একজন ট্যালেন্টেড অভিনেতাকে আজ হারালাম। প্রথমে খবরটা শুনে মনে হয়েছিল ফেক নিউজ। কিন্তু পরে খবরে দেখে নিজে বাকরুদ্ধ হয়ে যাই। তাঁর মত একজন অভিনেতার ছবি এই লকডাউনে বাড়িতে বসে দেখছিলাম। কি অসাধারণ অভিনয় শৈল্পী। সত্যিই ২০২০ সালটা আমাদের সকলের জন্য কতটা ভয়াবহ। একদিকে মানুষকে করোনার জন্য মরতে হচ্ছে, অন্যদিকে লকডাউনের জন্য মানুষকে অন্নাভাবে মরতে হচ্ছে। আবার এরকম একজন অভিনেতার মৃত্যু সত্যিই মর্মান্তিক।নির্দেশক অনির্বান চক্রবর্তী জানান, ভারতীয় সিনেমা জগতের জন্য তাঁর মৃত্যু একটা বড় ক্ষতি, তিনি যেমন ছিলেন একজন অসাধারণ অভিনেতা তেমনই ছিলেন একজন সুবক্তা ও সহৃদয় সজ্জন মানুষ।তিনি বেঁচে থাকলে আমরা অনেক কিছু পেতাম।