২০২৩ সালের পঞ্চায়েতের ক্ষমতা কাদের হাতে
অম্বর ভট্টাচার্য, তকমা নিউজ, কলকাতা, ৭ই জুলাই ২০২৩ : তকমা-র পক্ষ থেকে এবারের পঞ্চায়েত নির্বাচনের একটা আঁচ দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে, পঞ্চায়েত নির্বাচনের ফলাফল নিয়ে একটা ছোট্ট পর্যালোচনা, আমরা বিভিন্ন পঞ্চায়েতে কভারেজ করতে গিয়ে যা উপলব্ধি করেছি তাই তুলে ধরলাম মাত্র।
গতবারের জয় পরাজয়, তার পরে লোকসভা, বিধানসভার ফলাফল, সাংগঠনিক ক্ষমতা, প্রচারের অবস্থা ইত্যাদি খবরাখবরকে পাশাপাশি রেখে একটা ধারণা তৈরি করার চেষ্টা করছি আমরা। যে ধারণা থেকে পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলায় কোন দল কতটা এগিয়ে, কোন দলের ভোট পার্সেন্টেজ কতটা হতে পারে, কোন দল অন্তত জেলা পরিষদ নির্বাচনে কতগুলো আসনে জিততে পারে, তার হদিশ পাওয়া যাবে।
সেক্ষেত্রে সবথেকে বড় সমস্যা হল তৃণমূল দল, কারণ যেভাবে ২০১৮-র নির্বাচন হয়েছিল, বা বলা ভালো করানো হয়েছিল, তার ভিত্তিতে সংগঠন বা মানুষের সমর্থন কোনওটাই বোঝার কোনও উপায় নেই। কাজেই হিসেব করতে গিয়ে ২০১৯ আর ২০২১ এর নির্বাচনকেই গুরুত্ব দিয়েছি আমরা, এবং অবশ্যই এই মুহূর্তে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সাংগঠনিক শক্তির দিকেও চোখ রেখেই একটা ধারণা দেওয়ার চেষ্ঠা করছি। আজকের এই অঞ্চলের মধ্যেই রয়েছে পুরুলিয়া, বাঁকুড়া যেখানে ২০১৯-এ চমকে দিয়েছিল বিজেপি, আছে হুগলি যেখানে লকেট চট্টোপাধ্যায় জিতেছেন সবাইকে চমকে দিয়ে, আছে মতুয়াদের অঞ্চল যেখানে বিজেপির ভালো ক্ষমতা, আছে কাঁথির খোকাবাবুর অঞ্চল, পূর্ব মেদিনীপুর, যেখানে দাঁত কামড়ে তিনিও লড়ছেন, তৃণমূলও। আছে পশ্চিম মেদিনীপুর যেখানে আবার স্বমহিমায় সুশান্ত ঘোষ, এবং এই অঞ্চলেই আছে তৃণমূলের যুবরাজের দক্ষিণ ২৪ পরগনা যা এক প্রেস্টিজ ফাইট, যেখানে কেবল জিতলেই হবে না ভালোভাবে জিততে হবে। সেটাই আমাদের বিষয় আজকে, দক্ষিণবঙ্গের জেলাগুলোতে পঞ্চায়েত নির্বাচনের সম্ভাব্য ফলাফল।
দক্ষিণবঙ্গে আজকের আলোচনা পূর্ব আর পশ্চিম মেদিনীপুর, বাঁকুড়া, পুরুলিয়া, হাওড়া, হুগলি, উত্তর আর দক্ষিণ ২৪ পরগণা নিয়ে। এর মধ্যে দুটো নিয়ে মানুষের যথেষ্ট উত্সাহ আছে, দক্ষিণ ২৪ পরগনা আর পূর্ব মেদিনীপুর। এই দুই জেলা পরিষদে এগিয়ে থেকে তৃণমূলের যাত্রা শুরু হয়েছিল ২০০৮-এ, তারপর ২০০৯-এর লোকসভা নির্বাচনের ফলাফলই বলে দিয়েছিল জমানা বদল রহা হ্যায়। গতবার এই দুই জেলার ২০১৮র ভোটে দক্ষিণ ২৪ পরগনাতে ৬০.২৫ শতাংশ আর পূর্ব মেদিনীপুরে ৬২.২৭ শতাংশ ভোট পেয়েছিল তৃণমূল। কিন্তু এরই মধ্যে শুভেন্দু অধিকারীর দলবদল, নন্দীগ্রামে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হেরে যাওয়ার পরে পূর্ব মেদিনীপুরে তৃণমূলের সেই জোর নেই। এই জেলায় এবারে আক্ষরিক অর্থেই হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হচ্ছে, ফটো ফিনিশের জন্য অপেক্ষা করছে দুই দলই, মধ্যে বাম-কংগ্রেস কোনও দাগই ফেলতে পারবে কি? যদি তারা দুই কি তিনটে আসনও পায়, তাহলে তৃণমূল বোর্ড তৈরি করবে একথা বলাই যায়। বাম-কং ভোট ১৪-১৫ শতাংশ হলেই তৃণমূল খানিক সুবিধে পাবে।
দক্ষিণ ২৪ পরগনা কিন্তু তৃণমূল অনায়াসেই ধরে রাখবে, কাজের জন্য, সংগঠনের জন্য। কিন্তু গতবারের বিরোধী শূন্য ফলাফল হবে? না, তা সম্ভব নয়। বিজেপি, বাম, কংগ্রেস মিলে মোট ২০টার মতো আসন পাবে, এবারে তৃণমূলের ফলাফল ২০১৩-র মতোই হবে, সেবার তৃণমূল ৫৫টা আসন পেয়েছিল, এবারে ৫৮-৬০টা পাবে। বাম-কংগ্রেস-আইএসএফ জোট তিন নম্বরেই থাকবে। এবারে হুগলির ফলাফল বলে দেবে লকেট চট্টোপাধ্যায়ের আসনের ভবিষ্যত্, যা এখন থেকেই আমরা বুঝতে পারছি। হুগলি অনায়াসেই দখলে রাখবে তৃণমূল, উত্তর ২৪ পরগনা বা গ্রামীণ হাওড়াতেও তৃণমূল অনেক এগিয়ে। উত্তর ২৪ পরগনায় বিজেপি তেমন ভালো ফল করতে পারবে না আবার বামেরা ঘুরে দাঁড়ানোর লড়াইতে তেমন কিছু করতে পারবে এমনও নয়, জেলা পরিষদের গোটা ৫-৬ আসন তাঁরা পেতে পারেন। পশ্চিম মেদিনীপুরে বামেদের মিটিং মিছিল দেখা গিয়েছে কিন্তু তা ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য বড্ড কম, বাম এখানে জেলা পরিষদে বড়জোর ১টা আসনে জিতে গেলেও যেতে পারে। এখানেও জেলা পরিষদ অনায়াসেই তৃণমূলের দখলে থাকবে। পঞ্চায়েত নির্বাচনের এক চমক অপেক্ষা করছে পুরুলিয়াতে যেখানে কিছুদিন আগে পর্যন্ত বিজেপির বাড়বাড়ন্ত দেখা গেছে, সেই পুরুলিয়া কিন্তু এবারেও দখলে রাখবে তৃণমূল। কুড়মি ভোটারেরা ২০১৯-এ বিজেপিকে সমর্থন করেছিল, এবার তারা নিজেরা দাঁড়িয়েছে, তৃণমূল এই ইকুয়েশনে এগিয়ে। এছাড়াও কুড়মি সম্প্রদায় বিজেপির থেকে অনেকটা মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছে। পুরুলিয়ার বেশ কিছু জেলা পরিষদ আসনে বাম কং ভালো লড়ছে, তারাও ৬-৭টা আসন জিতলে অবাক হব না। বাঁকুড়াতেও বিজেপিই দ্বিতীয় স্থানে কিন্তু অনেক অনেক দূরে। বিজেপি এখানে এক ডজন জেলা পরিষদের আসন দখল করলেও জেলা পরিষদের ক্ষমতা হাতে পাবে না। আমরা এইসব জেলার বিভিন্ন পঞ্চায়েতে কভারেজ করতে গিয়ে যে একটা ধারণা হয়েছে সেখান থেকে একটা সমীক্ষা তুলে ধরলাম। এটা কিছুক্ষেত্রে শাসকদের বা বিরোধীদের পছন্দ নাই হতে পারে কিন্তু এটা আমাদের যা মনে হয়েছে সেটাই রাখলাম আপনাদের সামনে।
পঞ্চায়েত ভোটের নিরিখেই সাধারণ নির্বাচনের ফল বদলায়। আমরা বাংলার রাজনীতি দক্ষিণ ২৪ পরগনা আর পূর্ব মেদিনীপুর থেকেই বদলাতে দেখেছি, ২০০৯-এ এই দুই জেলা দখলে নিয়েছিল তৃণমূল। এবারে বাংলা ঘুরে যে রাজনৈতিক অবস্থা আমরা দেখলাম তাতে ২০১৯-এর বিজেপির ১৮ সাংসদের জমি দেখা গেল না। বরং অনেকটা ২০২১-এর ছায়া দেখা যাচ্ছে, এক আলিপুরদুয়ার ছাড়া নিশ্চিতভাবে জিতবই একথা বিজেপি নেতারা নিজেদের মধ্যে বলতে পারছেন না, সেই আলিপুরদুয়ারেও নাকি মেরামতের কাজে নেমেছে তৃণমূল। রইল বাকি পূর্ব মেদিনীপুর, এবারেও এই জেলাতে হচ্ছে প্রেস্টিজের লড়াই। শুভেন্দু এই জেলাতে জিতলে কিছুটা মুখরক্ষা হবে, হারলে মুখ পুড়বে। কিন্তু সারা বাংলা জুড়ে যে ফলাফল তা বিজেপির জন্য ২০২৪-এ খুব ভালো ফলের ইঙ্গিত দিচ্ছে না, ১৮ দূরস্থান, ৮টা থেকে ১০ আসনের বেশি পাওয়া কঠিন হবে আগামী লোকসভার নির্বাচনে। জেলা পরিষদের আলোচনাতে ফেরা যাক। আলিপুরদুয়ার আর পূর্ব মেদিনীপুর ছাড়া বিজেপির সম্ভাবনা কোথাও নেই আর বাম কংগ্রেসের একমাত্র ভরসা মুর্শিদাবাদ ও মালদহ।