‘ধনধান্যপুষ্পভরা’র কবি দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের (১৯জুলাই ১৮৬৩ – ১৭মে ১৯১৩) জন্মবার্ষিকীতে জানাই আমাদের শ্রদ্ধা ও প্রণাম
বিশেষ প্রতিনিধি, তকমা নিউজ, কলকাতা, ২৩শে জুলাই ২০২৩ : সাল ১৮৮৬ কি ৮৭। বিলেত থেকে কৃষিবিদ্যার ডিগ্রি নিয়ে এসে দ্বিজেন্দ্রলাল রায় পেলেন ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেটের চেয়ার। ১৮৯০’তে পোস্টিং পেলেন বর্ধমান রাজার অধীনে সুজমুঠা পরগনায়, হাতে পেলেন সেটলমেন্টের দায়িত্বও। চাকরি পাবার বছর খানেক বাদেই নিজের চব্বিশ-বছর বয়সে বিয়ে করেছেন হোমিয়োপ্যাথি চিকিৎসক প্রতাপচন্দ্র মজুমদারের মেয়ে এগারো-বছরের সুরবালা দেবী’কে। নিজের এমন এক ঘোরতর সংসারী সময়ে, দরিদ্র কৃষকদের আবেদনে তিনি হিসেব কষে এলাকার কৃষকদের খাজনা দিলেন কমিয়ে। কৃষকরা জয়ধ্বনি দিয়ে তাঁর নাম দিলে ‘দয়াল রায়’।
এদিকে এই ঘটনায় তাঁর নামে ব্রিটিশ সরকারের কাছে অভিযোগ করল বর্ধমান মহারাজার এক বিশেষ কর্মচারী। বিষয়টি দেখতে এলাকায় সশরীরে চলে আসে ছোটলাট। ‘সরকারের অনুমতি না নিয়ে কেন আপনি এমন কাজ করলেন?’ – ছোটলাটের এই প্রশ্নের উত্তরে দ্বিজেন্দ্রলাল রায় মুখের ওপর বলেদিলেন, ‘আপনি কিছু জানেন না, যা হয়েছে আইন মেনে হয়েছে.. আইন বিষয়ে আপনার কোনও অভিজ্ঞতা নেই।’ তাঁর এই কথায় সাংঘাতিক গণ্ডগোল বেধে গেল, বিষয় গড়াল আদালত পর্যন্ত। সেযাত্রা তাঁর কোনও রকমে চাকরি বাঁচলেও তারপর থেকে পদোন্নতি আটকে গেছে, ঘটেছে বহুবার বদলি। এই ঘটনায় দ্বিজেন্দ্রলাল রায় পরে ঘনিষ্ঠ মহলে বলেছিলেন, ‘জেনেবুঝে নিজের পায়ে আঘাত করলেও সমস্ত বঙ্গদেশ জুড়ে একটা উপকার করা গেছিল..’
কবি, নাট্যকার, গীতিকার দ্বিজেন্দ্রলাল রায় ১৮৬৩ সালের ১৯ জুলাই বাংলার নদীয়া জেলার কৃষ্ণনগরে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা ছিলেন বিখ্যাত গায়ক কার্তিকেয়চন্দ্র রায়, কাজ করতেন কৃষ্ণনগরের দেওয়ান হিসাবে, সেইসাথে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের নামকরা গায়ক ও লেখক এবং মা প্রসন্নময়ী দেবী ছিলেন বিখ্যাত বৈষ্ণব অদ্বৈত গুরুর বংশধর, তাঁদের ছয় পুত্র ও এক কন্যা। ভাইদের মধ্যে দ্বিজেন্দ্রলাল রায় ছিলেন সবার ছোট।
শিশু থেকে বালক বয়সের মধ্যে দ্বিজেন্দ্রলাল রায় দু-বার ঘোরতর শারীরিক বিপদ থেকে উদ্ধার পেয়েছিলেন, যাকে বলে ফাঁড়া কাটা। জন্মের কয়েক দিনের মধ্যে তিনি একবার ধাত্রীর কোল থেকে পড়ে গিয়ে মারাত্মক জখম হয়েছিলেন। এরফলেই তাঁর মুখ সামান্য বেঁকে গেছিল। আর বালক বয়সে ম্যালেরিয়া জ্বরে এমন অবস্থা হয়েছিল যে, ডাক্তার তাঁর জীবনের আশা প্রায় ছেড়ে দিয়েছিল। একবার ঢেঁকীর উপর পড়ে গিয়ে তাঁর একটি হাত ভেঙে যায়। এছাড়া তাঁর সম্পূর্ণ ছাত্র জীবনে তিনি বহুবার ম্যালেরিয়া জ্বরে আক্রান্ত হয়েছিলেন।
কিশোর বয়সেই তিনি একশটি গান রচনা করে ফেলেছিলেন। কৃষ্ণনগরে পড়াশোনা শুরু করে কৃষ্ণনগর কলেজ থেকে দশ টাকা বৃত্তিতে প্রবেশিকা (১৮৭৮) পরীক্ষা ও হুগলি কলেজ থেকে বিএ পাস করেন। এরপর কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে ইংরেজিতে এমএ (১৮৮৪) পাস করেন, অধিকার করেছিলেন প্রথম স্থান। কলেজ পাঠ শেষ করে ছাপরায় কিছু দিন শিক্ষকতা করেন। তারপর বাড়ির সকলের অমতে সরকারি অনুদানে চলে যান বিলেত, কৃষিবিদ্যা নিয়ে পড়তে (এপ্রিল, ১৮৮৪)।
বিলেতে গেলেও দ্বিজেন্দ্রলাল রায় ভুলে যাননি নিজের জাতিস্বত্তা, তাই লন্ডনে গিয়েও বাঙালি তথা ভারতীয় পোশাক পরে রাজপথে হেঁটেছেন। লন্ডন থেকে তিনি কৃষিবিদ্যায় তিনটি ডিগ্রি লাভ করেছিলেন। ১৮৮৬ সালে লন্ডন মানে কালাপানি পার হয়ে ফেরার পরে হিন্দু সমাজ তাঁকে জাতিচ্যুত করলে তিনি বিন্দুমাত্র পাত্তা দেননি। যদিও পরে ‘একঘরে’ (১৮৮৯) নামে এক ছোট বইতে তিনি সেই সময়কার সামাজিক কুসংস্কারকে তুলে ধরেছিলেন। তিনি যখন লন্ডনে, তখন দেশে তাঁর বাবা ও মা- দুজনেরই মৃত্যু ঘটেছিল, তাই দেশে ফিরে দ্বিজেন্দ্রলাল রায় চলে যান সূদুর মধ্যপ্রদেশ। সেখানে জরিপ ও রাজস্ব নীতির ট্রেনিং নেন এবং সরকারি ডেপুটির চাকরিও পান। পরে তিনি দিনাজপুরে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট নিযুক্ত হন।
দাম্পত্যজীবনে স্ত্রীর প্রতি অগাধ ভালোবাসায় তিনি বহু প্রেমের কবিতা ও গান লিখেছেন। রচনা করেছেন হাসির গানও। ১৯০৩ সালে স্ত্রী সুরবালাদেবী প্রসব অবস্থায় দেহ রাখেন, ছেলে দিলীপকুমার ও মেয়ে মায়া’কে নিয়ে বাকি জীবন সাহিত্যচর্চা করেই কাটিয়ে দেন দ্বিজেন্দ্রলাল রায়। প্রিয়তমা পত্নীর মৃত্যুতে তাঁর জীবনে আমূল পরিবর্তন এনেছিল। ছেলে দিলীপকুমার রায় ছিলেন সুভাষচন্দ্র বসুর অন্তরঙ্গ বন্ধু, পরবর্তীকালে ছেলে সম্পূর্ণ সন্ন্যাস জীবন-যাপন করতেন। দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের মৃত্যুর পরে রাষ্ট্রগুরু সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছেলে ভবশঙ্করের সাথে মেয়ে মায়া’র বিয়ে হয় (১৯১৬)।
১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গ বিরোধী ঐতিহাসিক স্বদেশী আন্দোলনে কবি দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের ঐতিহাসিক নাটক ও স্বদেশী গান আগুনে ঘি ঢালার মতো কাজ করেছিল। সাংস্কৃতিক ভাবে তিনি বঙ্গ-ভঙ্গ বিরোধী আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন। দেশপ্রেমে উজ্জীবিত দ্বিজেন্দ্রলাল রায় রচনা করেন কিছু ব্যঙ্গ গানও। স্বার্থপর রাজনীতিবিদ এবং তথাকথিত দেশভক্তদের উদ্দেশ্য করে রচিত তাঁর ব্যঙ্গরসাত্মক গান ‘নন্দলাল’ ও ‘আষাঢ়ে’। ‘বঙ্গ আমার জননী আমার’ গানটি তিনি আচার্য জগদীশচন্দ্র রায়ে’র অনুপ্রেরণায় রচনা করেছিলেন। দুর্গাপুজোর অষ্টমীর (১৯০৭) দিনে এই গানটি সুর দিয়ে গাওয়ার সময় আবেগে তিনি অজ্ঞান হয়ে গেছিলেন।
একসময় সাহিত্য সমালোচনা নিয়ে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের সাথে দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের সাময়িক মতোবিরোধ তৈরি হয়েছিল, যা একসময় হয়ে উঠেছিল বঙ্গ-সাহিত্য-পরিবেশে অন্যতম আলোচনার বিষয়। যদিও খুব তাড়াতাড়ি সে ভুলবোঝাবুঝি মিটে গেছিল।
প্রেমের, নাটকের, হাসির ও স্বদেশি গান মিলিয়ে প্রায় পাঁচশো গান লিখেছেন দ্বিজেন্দ্রলাল রায়। নাটক লিখেছেন একুশ’টি। ১৯০৫ সালে গড়ে তুলেছিলেন সাহিত্যসভা ‘পূর্ণিমা মিলন’। ‘ভারতবর্ষ’ পত্রিকা প্রকাশের ভাবনা প্রথম আসে তাঁরই মাথায়, যদিও নিজে প্রথম প্রকাশ দেখে যেতে পারেননি। রবীন্দ্রযুগেও বাংলা গানে বিভিন্ন ধারা ও আধুনিক গান রচনায় দ্বিজেন্দ্রলাল রায় হলেন একজন সার্থক রূপকার। নাটক রচনা ও পরিচালনায় তাঁর অসামান্য অবদান থাকলেও তিনি সঙ্গীতকার হিসেবেই সুপরিচিত ছিলেন বেশি। প্রথমদিকে তাঁর গান ‘দ্বিজুবাবুর গান’ নামে পরিচিতি পেলেও পরবর্তীকালে তা ‘দ্বিজেন্দ্রগীতি’ নামে সুপরিচিত হয়।
পুষ্পে পুষ্পে ভরা সাথী,
কুঞ্জে কুঞ্জে গাহে পাখি।
গুনজনিয়া আসে অলি,
কুঞ্জে কুঞ্জে ধেয়ে।
তারা ফুলের উপর ঘুমিয়ে পড়ে,
ফুলের মধু খেয়ে…🌷
দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের ‘সাজাহান’ নাটকটিকে বাঙালি মনে রাখেনি, কিন্তু মনে রেখেছে ‘ধনধান্যপুষ্পভরা আমাদের এই বসুন্ধরা’ গানটিকে। যেমনভাবে মনে রেখেছে ‘ওই মহাসিন্ধুর ওপার থেকে’ গান’টিকে.. যে গান’টি তিনি অন্য আর একটি নাটকে লিখেছিলেন। আর সেই নাটকেই সেই বিখ্যাত সংলাপ.. ‘চন্দ্রগুপ্ত’ নাটকের নাম বাঙালি ভুলে গেছে.. কিন্তু রচয়িতার নাম না মনে রেখেই মনে রেখেছে বিখ্যাত হয়ে যাওয়া সেই সংলাপটিকে – ‘সত্য সেলুকাস! কি বিচিত্র এই দেশ!’
আজ ‘ধনধান্যপুষ্পভরা’র কবি দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের (১৯জুলাই ১৮৬৩ – ১৭মে ১৯১৩) জন্মবার্ষিকীতে জানাই আমাদের শ্রদ্ধা, প্রণাম ও ভালোবাসা..