মা কালীকে কেন মুক্তকেশী এবং করালবদনা বলা হয় জনেন? জেনে নিন
অম্বর ভট্টাচার্য, তকমা নিউজ, কলকাতা, ১০ই নভেম্বর ২০২৩ : কালো রূপ অনেক আছে, এ বড়ো আশ্চর্য কালো। হৃদমাঝারে রাখলে পরে হৃদয় পদ্ম করে আলো।।
— শ্রী রামপ্রসাদ সেন
কালী মূর্তি সম্পর্কে একটি প্রশ্ন আসে মা বিবস্ত্রা কেনো ?
বস্ত্রর প্রয়োজন হয় মনের ভেতরে কামনা, বাসনা, লজ্জা, ভয় থাকলে। ভারতের বহু মহাপুরুষ শিব স্বরূপ হয়ে বস্ত্র পরেন না। মা কালী স্বরূপত পরমাত্মার শক্তি। শক্তিরূপিণী মা আদ্যা শক্তি পরমা প্রকৃতি। আদিকাল থেকেই বিশ্বব্রহ্মান্ড প্রসব করে চলেছেন। এখনও তাঁর সৃষ্টি কার্যের বিরাম নেই। যিনি ব্রহ্মান্ড সৃষ্ট করেছেন স্ব – অঙ্গ থেকে — তাঁর আবার লজ্জা কেনো ? এই মহা পরমাপ্রকৃতি কে সামান্য বস্ত্র দ্বারা আচ্ছাদন করার সাধ্য কারোর আছে কি ? সমগ্র ব্রহ্মান্ড ও তিনি তো এক ও অভিন্ন। তাই মা বিবস্ত্রা। তাঁকে আচ্ছাদন করতে পারে এমন কোন বস্ত্র এই জগৎ সংসারে নেই।
তাও উলঙ্গিনী মা কে সাধক কবির হার্দিক অনুনয়,– “মা, বসন পরো তুমি!”, কেন না, মা হয়ে সন্তানের সন্মুখে উলঙ্গ থাকা শোভনীয় নয়।
কিন্তু প্রশ্ন– যিনি সর্ব্বত্রব্যাপিনী বিশ্বমাতা, তাঁর আবরণযোগ্য বসন কই ?
কোনো কিছুকে আবরিত করতে হলে প্রয়োজন– তদপেক্ষা বৃহত্তর কোনোও বস্ত্রর উপস্থিতি, ব্রহ্মরুপিণী মায়ের চেয়ে উচ্চস্তরীয় কোনো তত্ত্ব জগতে আছে কি ?
তাঁর সমকক্ষ তত্ত্বও কি কেউ কল্পনায় আনতে সমর্থ ? না সম্ভব নয় তাই ভক্ত সন্তানের একান্ত প্রার্থনা সত্ত্বেও মায়ের বসন পড়া হয়নি, হওয়া অসম্ভব।
মা আমাদের নিত্যকালের জন্য দিগম্বরী, এই উলঙ্গিনী মায়ের করুণা প্রয়াসীকে বিবস্ত্র হয়েই তাঁর সমীপে যেতে হয়। সম্পূর্ণ রিক্ত হতে না পারলে মাকে পাওয়া যায় কি ?
সকল অবিদ্যা ও অহং এর তুচ্ছ আবরণ খুলে ফেলো, দেখবে, চিদানন্দময়ী মা হাসতে হাসতে তোমার কত নিকটবর্ত্তিনী। এ পরম রিক্ততার পুণ্য ধর্ম শিক্ষা দিতেই মা সর্ব্বাভরণহীনা দিগ্বসনা।
দিক হয়েছে বসন যাঁর, তিনিই দিগবসনা, তাৎপর্য্যগত অর্থে মা আপন চৈতন্যসত্তায় সকল দিক পরিব্যাপ্তকারিণী। দিকরূপ বসন তাঁকে আচ্ছাদিত করতে পারে না, কিন্তু তিনিই সকল দিক অতিক্রমণপুর্ব্বক অবস্থিতা।
ক্রিয়ার আধার যেমন কাল, বস্তুর আধার তেমন দিক। মা যেমন কালের নিয়ন্ত্রী, তেমনি তিনি দিকেরও নিয়ন্ত্রী, সকলই মায়ের অধীন।
জগতের তাবৎ বস্তু অনন্ত, অখণ্ড, অনাদি দিক বা দেশ আশ্রয়পুর্ব্বক বর্ত্তমান, পুনঃ দিক বা দেশ মায়ের আশ্রিত। মা যেমন কালের কলনকারিণী, তেমনি জগতের সর্ব্ববস্তুর আধার দিকেরও আশ্রয়দায়িনী। যিনি আধারেরও আধারস্বরুপা, তাঁর চেয়ে শ্রেষ্ঠ তত্ত্ব আর কি আছে ?
জীবের আশ্রয়দায়িনীও বস্তুতঃ তিনিই, যে দিকে দৃষ্টিপাত করবে, সে দিকেই মা। পুর্ব্ব, পশ্চিম, উত্তর, দক্ষিণ, উর্দ্ধ, অধঃ, ঈশান, বায়ু, অগ্নি, নৈঋত কোণ– সকল দিকেই সর্ব্বকালের দিগবসনা মা কোল বাড়িয়ে আছেন। সুখেও মা, দুঃখেও মা, সম্পদেও মা, বিপদেও মা, জীবনেও মা, মরণেও মা। মা ভিন্ন এতো আপনার জন আর কে আছে ?
বাস্তব দৃষ্টান্তেও তাই দেখি, মা যখন শাসনকারিণী, মাতৃগতপ্রাণ সন্তান কেঁদে কেঁদে পুনঃ ওই মায়ের কন্ঠই ধরে জড়িয়ে। সে ভালোই জানে, মাতৃক্রোড় ভিন্ন এতো নিরাপদ আর সুখকর স্থান আর কোথাও নেই।
সর্ব্বত্র চিন্ময়ী কালীর নিত্যসত্তা অনুভবপুর্ব্বক অনন্যাশ্রয়দায়িনী জ্ঞানে যিনি তাঁর একান্ত শরণাগত, তিনিই দিকতত্ত্বের উত্তম বেত্তা।
এই স্তরের সাধকই দিগবসনা মায়ের অপবাদ কীর্ত্তনকারী অর্ব্বাচীন সমালোচকগণের মুখর রসনা স্তব্ধ করে দিতে সমর্থ।
মা স্বয়ং বলেছেন —
“একৈ বাহং জগত্যত্র দ্বিতীয়া কা মমাপরা “
- অর্থাৎ এ জগতে আমি ভিন্ন দ্বিতীয় কেউ নেই। তাই আমার আবার বহু কি ?
যেখানে বহুত্ব বোধ নেই, সেখানে লজ্জাও নেই। মায়ের গাত্র বর্ণ কালো কৃষ্ণ বর্ণ। অসুর বধ কালে ক্রোধে তিনি কালো হয়ে গেছিলেন তাই নাম হয়েছে কালী। তবে শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেব বলেন অজ্ঞানী মানুষের কাছেই কালী কালো, জ্ঞানী বা তত্ত্বজ্ঞর কাছে কালী কালোও নয় কিছুই নয়। সমুদ্রের জল দূরে থেকেই নীল দেখায় কাছে গিয়ে হাতে নিলে কোন রং নেই। তাই মায়ের স্বরূপ অনুধ্যান করতে গেলে কালো রং চোখে পড়েনা। এই কালো রূপই তখন জ্যোতির্ময় ভাব ধারণ করে।
তবে এইটুকু চিন্তা করা যায় দেবীই মহাবিশ্বে এসব করেছেন। সুতরাং যখন কোন রঙই ছিলোনা তখন নিশ্চই কৃষ্ণবর্ণেই সমস্ত রূপ – রস – বর্ণ – গন্ধময় জগতের সংস্কার নিহিত ছিলো।
মায়ের ত্রি-নেত্র হলো কেনো ?
মায়ের এই ত্রিনেত্র হলো বহির্জগৎ, অন্তর্জগতের এবং জ্ঞাননেত্রর প্রতীক। মানুষ – মন স্বাভাবিকভাবে দুই চোখ ভরে বহির্জগৎই দেখে। আনন্দ উপভোগ করে। কিন্তু পুণ্যকর্মের প্রভাবে, সদ্ গুরুর কৃপায়, বিবেক – বৈরাগ্যর প্রভাবে কারও কারও অন্তর্চক্ষু বা জ্ঞান নেত্র উন্মেলিত হয়। জ্ঞাননেত্র উন্মুক্ত হলে মনে সদ্ চিন্তার ঢেউ ওঠে। মানুষ ক্রমে ব্রহ্মজ্ঞ হন। কাজেই মধ্য চক্ষু হলো জ্ঞান নেত্র।
মহানির্ব্বাণতন্ত্র বলে:–
“শশিসুর্য্যাগ্নিভিনের্ত্রৈরখিলং কালিকাং জগৎ ।
সম্পশ্যতি যতস্তস্মাৎ কল্পিতং নয়নত্রয়ম ।।”
মায়ের একটি নয়ন চন্দ্রস্বরূপ, আর একটি সুর্য্যস্বরূপ, তৃতীয়টি অগ্নিস্বরূপ। এই জ্যোতির্ম্ময় দিব্য ত্রিনয়ন দ্বারা সর্ব্বজ্ঞা দেবী জগতের ভূত, ভবিষ্যৎ, বর্তমান নিরীক্ষণ করেন।
অথবা বলা যায়, তাঁর ত্রিনয়নের ইঙ্গিতেই ত্রিকাল নিয়ন্ত্রিত হয়, আরও বলা হয়ে থাকে, দেবীর সুর্য্যাত্মক নেত্রই দিবা, চন্দ্রাত্মক নেত্রই রাত্রি এবং অগ্ন্যাত্মক নেত্রই এই দুইয়ের সন্ধিকাল সন্ধ্যা।
অর্থাৎ দেবীর মধ্যে চন্দ্রের ষোলোকলা, সূর্য্যের বারোকলা, এবং অগ্নির দশকলা বিদ্যমান।
আবার মা কেনো আলুলায়িত মুক্তকেশধারিণী ?
আসলে মায়ের স্বরূপ হলো অগম্যা, অনির্বচনীয়। তিনি একদিকে মহাবিশ্বরূপে প্রকটিতা যা আমরা দর্শন করি, আবার অপর দিকে তিনি অগম্যা যাঁর স্বরূপ আমরা কিছুতেই বুঝে উঠতে পারিনা। আলুলায়িত কেশরাশির মাধ্যমে মায়ের অনন্তরূপের একাংশ চিরকালই আমাদের কাছে ঢাকা থাকে। এজন্যই মহারাজ শিবচন্দ্র গেয়েছেন –
“যে অবধি যাঁর অভিসন্ধি হয়, সে অবধি সে পরব্রহ্ম কয়।
তৎপরে তুরীয় অনির্বচনীয় সকলি মা তারা ত্রিলোকব্যাপিনী।।
মা মুক্তস্বভাবা, তাই তিনি মুক্তকেশী, তদীয় জ্ঞানখড়গের ক্ষেম আঘাতে অষ্টপাশ ছিন্ন হলেই নিস্কাম সাধক চিন্ময়ী মাকে পায়। মাকে পেলেই মুক্তি, ভক্তকবি রামপ্রসাদ তাই গেয়েছেন,–
মুক্ত কর মা মুক্তকেশী ।
ভবে যন্ত্রণা পাই দিবানিশি ।।
কিন্তু মুক্তি-সাধনার উপায় কি ?
মাতৃ প্রতিমার প্রতি ধ্যাননিবিষ্ট চিত্তে নেত্রপাতেই এ প্রশ্নের উত্তর স্বতঃ উদ্ভাসিত হয়, নগ্না মা কেশবিন্যাসাদি প্রসাধনবিমুখা– চিরবৈরাগ্যময়ী– ত্যাগের জ্বলন্ত, জীবন্ত বিগ্রহ। ত্যাগেই অমৃত, ত্যাগেই মুক্তি।
শক্তিতত্ত্বের মূলকথা হলো শরীরের মহাশক্তি ও কুণ্ডলিনী শক্তিকে জাগানো, কারণ জীবের চৈতন্যলাভ হলে তবেই শব রুপী শিব হয়ে পরমেশ্বরী কালিকার শ্রীচরণ লাভ করবে।
তাই সাধকের কর্ত্তব্য নিজ সাধনাকে গভীরে নিয়ে যাওয়া এবং সিদ্ধিলাভ না হওয়া পর্যন্ত লেগে থাকা। সাধনার বীজ হলো “ওঁ” অর্থাৎ “কালী”, তাই কালী ও কুণ্ডলিনী শক্তি পরাশক্তি পরাপ্রকৃতির অভিন্ন প্রকাশ।
দেবী মায়াপাশে আমাদের আবদ্ধ করে রেখেছেন, তাঁর আলুলায়িত মুক্তকেশ মায়াপাশেরও প্রতীক। আবার তিনি ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও মহেশ্বরের মুক্তি বিধান করেন বলেই তিনি মুক্তকেশী।
কেশ মানে ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও মহেশ্বর।
ক+অ+ঈশ= কেশ,
ক= ব্রহ্মা,
অ= বিষ্ণু,
ঈশ= শিব,
“কেশ”কে মুক্ত করেন বলেই মা আমার “মুক্তকেশী”।
মায়ের মুখমণ্ডল অতি ভীষণ– সমগ্র অনাত্মভাবকে গ্রাস করে মা “করালবদনা”,
যে স্থানে সর্ব্ববর্ণের সর্ব্বভাবের লয়, যেখানে কিছুই নাই, তা যে কত ঘোর, কৃষ্ণ, অপ্রকাশ্য, তা ভাষায় বোঝানো অসম্ভব! তাই মা ঘোরা কৃষ্ণবর্ণা।