তথ্য রহস্যপ্রথম পাতা

১৯৯৮ সালে সুইডেনের স্টকহোমে দেওয়া নোবেল বক্তৃতায় রবীন্দ্রনাথ ও কাজী নজরুল নিয়ে কি বলেছিলেন অমর্ত্য সেন?

“শৈশবে বাঙালি কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সংসর্গে আসার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল। এটাও মনে রাখা প্রয়োজন যে,ভারত ও বাংলাদেশ—দুই দেশের জাতীয় সঙ্গীতের রচয়িতা তিনিই। সেই মানুষটির আরও নানা কৃতির সঙ্গে এটাও বলা প্রয়োজন যে,তিনি ১৯১৩ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন। শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথ এক আশ্চর্য বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন, যেখানে আমার পিতামহ শিক্ষকতা করতেন। আমি এই বিদ্যালয় চত্বরেই জন্মগ্রহণ করি। এই বিদ্যালয়ের লক্ষ্য ছিল শিক্ষার্থীদের একই সঙ্গে স্থানীয় আর বিশ্বায়িত শিক্ষা দান করা। রবীন্দ্রনাথ বিষয়টিকে এই ভাবে দেখেছিলেন— মানবের যা কিছু কীর্তি আমরা দেখি আর উপভোগ করি না কেন, উৎস নির্বিশেষে তা আমাদের সম্পত্তি হয়ে দাঁড়ায়। তাঁর বিশ্বজনীন, সহিষ্ণু আর যুক্তিশীল মতাদর্শ আমার চিন্তনে গভীর প্রভাব রেখেছে। এই ভেদ সৃষ্টিকারী সময়ে দাঁড়িয়েও আমি তাঁর ভাবনাগুলিকে স্মরণে আনি।

ভারতীয় পদার্থবিজ্ঞানী চন্দ্রশেখর যখন নোবেল পুরস্কার পান, তিনি রবীন্দ্রনাথের একটি কবিতা উদ্ধৃত করেছিলেন। যেখানে চিত্তের মুক্তির প্রসঙ্গে বলা হয়েছিল—“যেথা তুচ্ছ আচারের মরুবালুরাশি/ বিচারের স্রোতঃপথ ফেলে নাই গ্রাসি।” আমি চন্দ্রশেখরের মুখে রবীন্দ্রনাথের এই চিত্ত-মুক্তির প্রশংসার বাণীর প্রশংসা করছি।

রবীন্দ্রনাথ ১৯৩০ সালে অক্সফোর্ডে দেওয়া ‘হিবার্ট লেকচারস’-এ অত্যন্ত স্পষ্ট ভাষায় বাংলার সংস্কৃতির সমন্বয়ধর্মী চরিত্রের দিকটি আলোচনা করেছেন। এই বক্তৃতায় তিনি নিজেকে ‘হিন্দু, মুসলমান, ও ব্রিটিশ—এই তিন সংস্কৃতির সঙ্গমের ফল’ বলে অভিহিত করেন। তাঁর এই বর্ণনা যে কোনও ধরনের সঙ্কীর্ণ সাম্প্রদায়িক পরিচিতিকে সরাসরি খারিজ করে, আবার অন্তর্নিহিত অর্থে তাঁর এই কথা ক্ষুদ্রতার বিরুদ্ধে এক প্রশস্ততর মানব মর্যাদার উদ্‌যাপন করে। এই ঐতিহাসিক অনুধাবনটি বাংলা সাহিত্য-সংস্কৃতিতে ব্যাপক গুরুত্ব পেয়েছে। রবীন্দ্রনাথের পরে নিঃসন্দেহে বাংলার সর্বাপেক্ষা জনপ্রিয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম। সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে তাঁর বেশ কিছু কবিতা অসংখ্য বাঙালি পাঠকের মনে অমর হয়ে গেঁথে আছে। নজরুলের বিশ্বজনীন মানবতার সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল বামপন্থার প্রতি তাঁর সমর্থন। ১৯২৫ সালে প্রথম প্রকাশিত লাঙ্গল নামক বামপন্থী পত্রিকা নিয়মিত নজরুলের কবিতা ছাপত। এর প্রথম সংখ্যায় প্রকাশিত হয় তাঁর লেখা। লক্ষণীয় ব্যাপার হল,সেই সংখ্যাতেই অন্যান্য লেখার মধ্যে ছিল কার্ল মার্ক্সের একটি জীবনী ও ম্যাক্সিম গোর্কি-র মা উপন্যাসের তর্জমা। লাঙ্গল-এর গৃহীত যে নীতি কাগজের প্রতি সংখ্যার প্রচ্ছদ-নিশানে ছাপা হত,সেটা পঞ্চদশ শতকের বাঙালি কবি চণ্ডীদাসের একটি কবিতা থেকে নেওয়া:-“শুনহ মানুষ ভাই সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই।’’

এর অন্তর্নিহিত যে ধারণা,সেটাই ছিল সম্পূর্ণ ভাবে নজরুলের নিজের কথাও। কিন্তু পাঁচশো বছর আগেকার বাংলা সাহিত্যের সম্ভার থেকে কবিতার এই পঙ্‌ক্তিটা যে তখনও তুলে নেওয়া গিয়েছিল,এটাও বাঙালি সংস্কৃতির একটা বিশেষত্ব। বাঙালি চিন্তায় নজরুলের প্রভাব খুবই জোরালো। তাঁর ‘বিদ্রোহী কবি’ পরিচয় তাঁকে একটা বিশিষ্ট স্থান করে দিয়েছে এবং রাজনৈতিক পরিপ্রেক্ষিতে অনেক ক্ষেত্রেই এমনকি কট্টর রবীন্দ্রভক্তরাও রবীন্দ্রনাথের দার্জিলিং চা-এর মতো স্নিগ্ধ সুরভির তুলনায় নজরুলের কড়া অসম চা-এর স্বাদটা বেশি পছন্দ করেন। আমার যৌবনে প্রায় এমন কাউকে দেখিনি যে নজরুলের কাণ্ডারী হুঁশিয়ার কবিতাটা মুখস্থ বলতে পারত না। কান্ডারির প্রতি তাঁর বিশেষ হুঁশিয়ারি:-

‘হিন্দু না ওরা মুসলিম? ওই জিজ্ঞাসে কোন জন? কাণ্ডারী! বল,ডুবিছে মানুষ,সন্তান মোর মার।’

শত শত বছরের ইতিহাস ধরে বাহিত বাঙালি পরিচিতির বিভিন্ন উপাদানের মধ্যে দিয়ে একটি যথাযথ ও শান্তিপূর্ণ সমাজ গড়ে তোলার বিপুল সম্ভাবনাও আছে। বাঙালি পরিচিতি বিপর্যয়ের প্রতিষেধক না হতে পারে কিন্তু এর মধ্যে একটি সুস্থ সমাজ গড়ার প্রভূত সংসাধন আছে, যদি নাকি আমরা ঘৃণা ও হিংসার দানবটাকে দমন করতে পারি। বহু যুগ ধরেই বাঙালিরা গঠনমূলক বাঙালি পরিচিতির একটি উজ্জ্বল ছবি আঁকার প্রলোভন লালন করে এসেছেন ….

আমার মাতামহ ক্ষিতিমোহন সেন (১৮৮০-১৯৬০) পেঙ্গুইন বুকস-এর জন্য হিন্দুধর্মের ওপরে হিন্দুইজ়ম নামে একটা বই লিখেছিলেন। বইটা খুবই সার্থকতা অর্জন করে এবং ফরাসি থেকে ফারসি পর্যন্ত নানা ভাষায় অনূদিত হয়। (বাংলায় হিন্দুধর্ম, আনন্দ)। এ বইতে ক্ষিতিমোহন বারংবার একটি সাংস্কৃতিক দিকের কথা উল্লেখ করে যা বলতে চাইছেন তা হল,নিছক পারস্পরিক সহিষ্ণুতা নয়,হিন্দু ও মুসলমানের মধ্যে সুসম্পর্কের আসল ব্যাপারটা হল পারস্পরিক সহযোগিতার ভিত্তিতে যৌথ ভাবে কাজ করা। তাঁর সুগভীর গবেষণা প্রসূত হিন্দু-মুসলমানের যুক্তসাধনা গ্রন্থে তিনি খুব জোর দিয়ে বলেছেন, কেবল সহিষ্ণুতার চেয়ে যৌথ কাজ করাটা কত বেশি জরুরি। বাংলায় হিন্দু-মুসলমান সম্পর্ক বিষয়ে জানতে গিয়ে আমরা দেখতে পাই এই দুই সম্প্রদায়ের ঘনিষ্ঠ সহযোগিতার ইতিহাসটা কত দীর্ঘ …

(১৯৯৮ সালে সুইডেনের স্টকহোমে দেওয়া নোবেল বক্তৃতা এবং ২০১৯ সালে কলকাতায় দেওয়া আইডিএসকে প্রতিষ্ঠা দিবসে দেওয়া বক্তৃতার অনুবাদের অংশ বিশেষ)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *