যাদবপুর থেকে যদুবাজার মিছিলে মমতা পরিচিত মুখ পিছনে রেখে একা এগিয়ে গেছেন হিংসা অবরোধ ছেড়ে শান্তির পথে অন্দোলনে
অম্বর ভট্টাচার্য, এবিপিতকমা, কলকাতা, ১৮ই ডিসেম্বর ২০১৯ : সোমবারের পর মঙ্গলবারও। পরপর দুদিনের মিছিলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে দেখা গেল এক নতুন স্টাইলে। সংগঠনের নেতা, পদাধিকারীদের পরিচিত মুখগুলি যাদের মমতার মিছিলে প্রায়ই দেখা গিয়ে থাকে, তাদের এবার অনেকটা পিছনে রেখে আলাদা এগিয়ে ছিলেন মমতা। সোমবার তাঁর সঙ্গে ছিলেন খেলোয়াড় আর দুএকজন ধর্মীয় নেতা থেকে অভিনেতা সোহম, সাংসদ মিমি ও নুসরত। এরা যদিও দলের সাংসদ তার চেয়ে বেশি পরিচিত তারকা হিসেবে।নতুনদের মধ্যে দেখা গেছে তপন দাশগুপ্ত, অরূপ চক্রবর্তী, বিশ্বজিত মন্ডল সহ অনেকে।পিছনে ছিলেন ফিরদৌসী বেগম, মধুমিতা চক্রবর্তী, অনিতা কর মজুমদার, মিতালি ব্যানার্জি, সুস্মিতা দামের মত পৌরমাতারা।যদুবাবুর বাজারে মঞ্চে দেখা গেছে স্থানীয় সাংসদ মালা রায়কে। ভাষণ দেন সৌগত রায়। এর বাইরে সব নেতা, বিধায়ক, সাংসদ, পুরপিতা, যুব ও ছাত্রনেতা, পদাধিকারীরা নেত্রীর থেকে অনেক পিছনে। সূত্রের খবর, বিশেষ কারণে পরিকল্পিতভাবেই এই নতুন স্টাইলে নয়া আইনের বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে চাইছেন মমতা। তারও পিছনে শিক্তিপদ মন্ডল, দোলা সেন।
বেড়ালের গলায় ঘন্টা বেঁধে তিনিই প্রথম NRC ও CAB-এর বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছিলেন। এখন গোটা দেশ না হলেও বেশ কয়েকটা রাজ্য কেন্দ্রের এই তুঘলকি কান্ডের বিরুদ্ধে গর্জে উঠেছে। ত্রিপুরা জ্বলছে, আসাম জ্বলছে, উত্তর-পূর্ব ভারত জ্বলছে, দিল্লি জ্বলছে। বাংলাই এই প্রতিবাদের পথ প্রদর্শক। আগামী দিনেও বাংলা প্রতিবাদ করবে। তবে সেই প্রতিবাদের পথ হবে শান্তির এটা বারবার মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি সকলের প্রতি অনুরোধ জানিয়েছেন।এভাবেই রাজ্যের মানুষকে NRC ও CAB বা CAA-এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদের বার্তা দিলেন মুখ্যমন্ত্রী তথা তৃণমূলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
এদিন যাদবপুর থেকে ভবানীপুর যদুবাবুর বাজার পর্যন্ত বিশাল মিছিল করার পর মমতা বলেন, “মানুষের স্বার্থে আমাদের এই লড়াই আন্দোলন চলবে। আমি সকলকে NRC-CAB নিয়ে প্রতিবাদ করতে বলছি। কিন্তু কোথাও কোনও হিংসা নয়, বাস-ট্রেনে আগুন নয়, অবরোধ নয়। শান্তির পথে প্রতিবাদ করুন। আমিও মিছিল করছি, সাধারণ মানুষের একটু অসুবিধা হচ্ছে। তবে বাস-ট্রেনে আগুন ধরালে বা অবরোধ করলে কোনও সমস্যার সমাধান হবে না। সকলে শান্তি-সম্প্রীতি বজায় রেখে মিটিং-মিছিল করুন।”
এরপরই মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “যখন গোটা আকাশ অন্ধকার হয়ে থাকে, তখন মানুষ একটু আলোর সন্ধানে চায়। সেটাই আমরা করতে চাইছি। ভারতের এমন জায়গা নেই যেখানে আন্দোলন হয়নি। যাঁরা দেশের স্বাধীনতা এনেছেন, এখন তাঁদের নাগরিকত্ব ছিনিয়ে নিতে চাইছে ওরা। এটা বিজেপির চক্রান্ত। একটা রাজনৈতিক দল ভোট জিতে যা ইচ্ছা তাই করতে চাইছে। সব কিছু নিজের বললে চলবে না। ভেদাভেদের রাজনীতি আমরা করতে দেব না। সংখ্যা দিয়ে আইন পাস। গায়ের জোরে রাতের অন্ধকরে বিল পাস। সংবিধান মেনেছো?
এখানেই থেমে থাকেনি মমতা। সুর চড়িয়ে বলেন, “আমাদের এই লড়াই জিততেই হবে। কারও জীবনের নিরাপত্তা নেই। তাই আমরা বলছি , আমরা সবাই নাগরিক। নাগরিক নাগরিকের মধ্যে কোন ভেদাভেদ করা যাবে না। আমরা এখানে আছি। এটা কোনওদিন করতে দেব না। স্বাধীনতার ৭৩ বছর পার করে ডিভাইড এন্ড রুল চলবে না। রবীন্দ্রনাথ একটা রাখি দিয়ে মেলবন্ধন করেছিলেন। আমরা সেই রবি ঠাকুরের বাংলায় থাকি।”
কেন্দ্রের বিজেপি সরকারকে কটাক্ষ করে মমতা বলেন, “বাজার জ্বলছে, গ্রাম জ্বলছে, শহর জ্বলছে। মানুষের মন অন্যদিকে ঘুড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা। বাজারে আগুন দামে পেঁয়াজ বিক্রি করছে। এখন NRC আর CAB বিক্রি করতে চাইছে। ওরা নাকি সবাইকে নিয়ে চলবে। সব কা সাথ সব কা বিকাশ করবে, আর সবাইকে দেশ থেকে বের করে দিয়ে ওরা একা থাকবে।। ওদের ভাষায় আমরা নাকি কেউ নাগরিক নই। যারা দেশের স্বাধীনতার লড়াই লড়েছে, তারাই নাকি নাগরিক নয়? যারা বাইরে থেকে আসবে তাদের ৫ বছর পর নাগরিকত্ব দেবে। আসলে ওরা ১০ হাজার লোককে নাগরিকত্ব দিয়ে এক লাখ মানুষের নাগরিকত্ব কেড়ে নেওয়ার চক্রান্ত করছে। আসামেও হিন্দুদের বাদ দিয়েছে। গুলি করে মেরেছে। বাংলায় ৩০জন আত্মহত্যা করেছে। তার দায় কে নেবে? বহু রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীরা বলছেন NRC-CAA করতে দেব না। এখন নিজের বাঁচার জন্য একটা সময় বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলোর মুখ্যমন্ত্রীও বলবে NRC-CAA করতে দেব না।” এবার চাপে পড়ে নাগরিকত্বের পরিবর্তিত আইন এনেছে বলছে CAB।
কিন্তু বাংলার অনেক মানুষ বলছে এই নতুন আইনে মানুষের সেভাবে অসুবিধা হবে না।২০১৪ সাল পর্যন্ত যারা ছিল তারা সেখানেই থাকবে কিন্তু আফঘানিস্থান, পাকিস্থান ও বাংলাদেশ থেকে যে হিন্দু, শিখ, বৌদ্ধধর্ম জাত, জৈন ধর্মজাত, পার্সি ধর্মজাত এবং ক্রিস্টান ধর্মজাত কোন মানুষ ভারতে আসে তাদের কমপক্ষে পাঁচ বছরের স্থায়ী বাসিন্দা হতে হবে।এর আগে এই নিয়মে ছিল ১১ বছর। কেন্দ্র সরকার তাঁর নিয়মাবলীতে বলেছে আকিস্থান ও বাংলাদেশ ব্যতীত অন্য দেশের বংশদ্ভুত ভারতীয় ভারতে আসতে গেলে তাঁকে OCI আবেদনের মাধ্যমে আসতে হবে। এই নিয়মের ফলে অনেক অনুপ্রবেশকারীরা ভারতের নাগরিকত্ত্ব পাবে না। তাঁরা ভারতীয় নাগরিকদের সুবিধা পাবে না। কিন্তু তাদের ভারতের বাইরে যেতে হবে না। ভারতে থাকতে পারবে তবে সুবিধা পাবে না। এর ফলে যারা আসল নাগরিক তাদের সুবিধা হবে। বহু রাজনৈতিক দল এই NRC বা CAB-র ভুল ব্যাখ্যা করে মানুষকে বিভ্রান্ত করছে। আইনে কোথাও বলা নেই যে যারা NRC বা CAB-এর বাইরে তাঁরা ভারতের বাইরে যেতে হবে। এই বিভ্রান্তির ফলে দেশে আন্দোলনের নামে যে ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছে তার মাসুল কে বা কারা দেবে?