রাজপুর সোনারপুর পৌরসভার উপ পৌরপ্রধান শান্তা সরকার কাটমানির দায়ে অপসারিত, দীর্ঘদিনের ক্ষোভ ছিল তার অকথ্য ব্যবহারের জন্য
অম্বর ভট্টাচার্য, এবিপিতকমা, সোনারপুর, ২২শে জুন ২০১৯ : শান্তা সরকার যে তার পুর অফিসে কারও সাথে সভ্য ব্যবহার করতেন না এটা নিয়ে অনেকেরই ক্ষোভ ছিল। কিন্তু কেউ কিছু মুখে বলতে পারতো না কারণ তিনি তৎকালীন রাজ্যের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী, মেয়র তথা জেলা সভাপতি শোভন চ্যাটার্জির খুব ঘনিষ্ট ছিলেন যদিও পরে পারিবারিক সূত্রে তিনি মন্ত্রী তথা মেয়রের আত্মীয় হয়ে যান।শোভন চ্যাটার্জির ভাইঝিকে বিয়ে করে পিঙ্কু সরকার। তিনি তার সান্নিধ্যে থাকার জন্যই রাজপুর সোনারপুর পৌরসভার ভাইস চেয়ারম্যান পদের মর্যাদা পান। কিন্তু এই অফিসটাকে তিনি তার নিজের বাড়ি করে ফেলেছিলেন। পুর অফিসে তিনি তার নিজের মর্জিতে আসতেন প্রায় বিকেল ৫টায়, পুর অর্থে তিনি নিজের মনমর্জি ব্যয় বহুল টিফিনটাও খেতেন বলে অভিযোগ ওঠে।এরপর তো তিনি যেভাবে মেকআপ করে আসতেন তাতে যেকোন মিস ইন্ডিয়া বা মিস ইউনিভার্স হার মানবে।এছাড়া তিনি তার অধীনে থাকা পুর প্রতিনিধিদের সাথে দুর্ব্যবহার করতেন বলেও বহুবার অভিযোগ ওঠে। একবার তো সোনারপুর দক্ষিণের কিছু পুরমাতার সাথে প্রায় হাতাহাতি হওয়ার উপক্রম। এমনকি লোকসভা নির্বাচনের আগে পুর প্রধান ডাঃ পল্লব দাসের সাথে এমন দুর্ব্যবহার করেন যে তিনি অফিসেই আসা বন্ধ করে দেন।আমরা সেই খবর করেছিলাম, আর সেই খবর প্রকাশ হতেই বেশ কিছু ফোন আসে, বলা হয় লোকসভা নির্বাচনের আগে কেন এই খবর প্রকাশিত হল। এতে ভোটে প্রভাব পড়বে। বোঝাই যাচ্ছিল যে সেই ফোনগুলো পিঙ্কু সরকারের নির্দেশেই হয়েছিল। এত সব তিনি করতে পারতেন তার দাদা সঞ্জীব সরকার (পিঙ্কু)-এর জোরে। এরবার আমরা তার একটা কান্ডের কথা তুলে ধরেছিলাম বলে এই পিঙ্কু সরকার আমাদের হুমকির সুরে বলেছিলেন সম্পূর্ণ ব্যপারটা জেনে প্রকাশ করলেই ভাল হত। তখন তার ওয়ার্ডে থাকা এক ট্যাক্সি ড্রাইভারের পৈতৃক সম্পত্তির উপর প্রায় একপ্রকার জোরজুলুম বেদখল করে পাইয়ে দিয়েছিলেন সেই ট্যাক্সি ড্রাইভারের ভাইকে কারণ সেই ভাই শান্তার অনুগামী ছিল। আমরা সেই খবর প্রকাশ করেছিলাম তাই তিনি ও তার দাদা সেই ট্যাক্সি ড্রাইভারকে এলাকার তার পক্ষে থাকা কিছু গুন্ডাকে নিয়ে হুমকিও দিয়েছিলেন। যদিও পরে সেই ট্যাক্সি ড্রাইভার আমাদের ফোন করে বলেছিলেন “দাদা ছেড়ে দিন, আমরা পারবো না ওদের সাথে। আমরা সম্পত্তি বেচে চলে যাব।আসলে শান্তা সরকার ও সঞ্জীব সরকার কাউকে মানুষ বলে মনে করতো না, বা করেও না।সঞ্জীব সরকার ডাঃ পল্লব দাসের ওয়ার্ডে একটা বহু প্রাচীন পুকুর ভরাট করতে শুরু করেছিল। সেই সময় ডাঃ পল্লব দাসের বাবা খুব অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ছিলেন। আমরা খবর পেয়ে ডাঃ পল্লব দাসকে ফোন করতে তিনি বলেন, ঘটনাটা জানা নেই। এরপর পিঙ্কুকে ফোন করতে তিনি বলেন গার্ড ওয়াল হচ্ছে। গার্ড ওয়াল করতে গাড়িকে গাড়ি মাটি লাগে জানা ছিল না। সেই পুকুরটার সাথে এলাকার মানুষের একটা সেন্টিমেন্ট জড়িয়ে ছিল। প্রায় ৩৫০ বছরের পুকুর ছিল।ডাঃ পল্লব দাস জেনেও ভয়ে হয়তো সেদিন কিছু বলতে চান নি।এত গেল রাজনৈতিক অত্যাচারের কথা। আর তার দাদা মানে পিঙ্কু সরকার, তাকে নিয়ে তো তোলাবাজির অনেকবার খবর হয়েছে।এবার আসি শান্তা সরকারের কিছু প্রশাসনিক অত্যাচারের কথায়। ভাইস-চেয়ারপার্সন পদে থাকাকালীন শান্তা সরকার যে দফতরগুলি দেখভাল করতেন যেমন যে কোনও ধরনের ট্রেড লাইসেন্স করতে বা মিউটেশন করাতে বড় অঙ্কের অর্থ দিতে হত। কেউ এলাকায় কোনও ছোট কারখানা খুলতে চাইলেও অন্তত ৪০ হাজার টাকা ঘুষ দিতে হত বলেও অভিযোগ। কেন্দ্রীয় অর্থ সাহায্যে গরিবদের জন্য যে আবাস যোজনা রয়েছে তাতেও শান্তা দুর্নীতি করেছেন বলে অভিযোগ।ভাইস-চেয়ারপার্সন শান্তা সরকারের বিরুদ্ধে বহু বছর ধরেই পাহাড় প্রমাণ দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। এই নিয়ে বহুবার বহু মানুষ অভিযোগ করেছেন। কিন্তু কোনও লাভ হয়নি। অভিযোগ, মিউটেশন, ট্রেড লাইসেন্স থেকে শুরু করে নানা কাজে কাটমানি নিতেন শান্তা সরকার। তাঁর নেতৃত্বে সোনারপুর-রাজপুর পুরসভায় একটি চক্রও তৈরি হয়েছিল বলে অভিযোগ। আর এই পুরো কাজটি শুধুমাত্র তার দাদা পিঙ্কু সরকারের অঙ্গুলিহেলনিতে চলতো। এককথায় বলা যেতেই পারে পিঙ্কুর কথাতেই চলতো পুরো রাজপুর সোনারপুর পৌরসভাটা। এমনকি কোন কোন কাউন্সিলার পিঙ্কুর সাথে আলোচনা করে প্রোজেক্ট জমা করতো, সোনারপুর উত্তরের কিছু কাউন্সিলারও আছে সেই তালিকায়।কিন্তু অত্যাচারের দিন তো শেষ হয়। তাই মুখ্যমন্ত্রীর ঘোষণার পরই কাটমানি বিতর্কে ভাইস-চেয়ারপার্সন শান্তা সরকারের পদ চলে গেল। এই মর্মে শুক্রবার বিজ্ঞপ্তিও ইস্যু করা হয়েছে। পুনর্গঠন করা হয়ে গিয়েছে সোনারপুর রাজপুর পুরসভার পৌরপ্রধান পারিষদ। কিন্তু এমনটা জানা গেল যে এব্যাপারে তাঁর কাছে নাকি কোনও খবর নেই।
কিন্তু, প্রশ্ন হচ্ছে তিনি যে ভাইস-চেয়ারপার্সন পদে আসিন ছিলেন সেটা-তে কোনও নিয়োগমূলক পদ নয়। এই পদে আসিন হতে যে দলের পুরবোর্ড সেই দলের একটা সম্মতি লাগে। এরপর পুরপারিষদের বৈঠকে নাম প্রস্তাবিত হবে। সেই প্রস্তাবের প্রেক্ষিতে পুরপারিষদের সম্মতি নিয়ে পদে আসিন হতে হয়। এর জন্য একটি রেজিস্ট্রারে সই করতে হয়। সুতরাং, অপসারিত হওয়ার পরও শান্তা সরকার কোন লিখিত চিঠির অপেক্ষায় রয়েছেন তা বোঝা যায়নি। জানা গিয়েছে, পুরনো পৌরপ্রধান পারিষদ যে ভেঙে দেওয়া হয়েছে তার চিঠি পারিষদ সদস্যের হাতে শুক্রবার সকালেই পৌঁছে গিয়েছিল। কারণ, এই চিঠিটি ছিল ,সোনারপুর-রাজপুর পুরসভার পৌরপ্রধান পারিষদের পুনর্গঠনের এবং এতে কোন কোন সদস্য আছেন তাদের নামের উল্লেখ ছিল এখানে। সোনারপুর-রাজপুর পুরসভার চেয়ারম্যানের সই করা এই চিঠি শান্তা সরকারের বুঝে নেওয়ার জন্য যথেষ্ট ছিল যে তিনি আর পৌরপ্রধান পারিষদে নেই। যদি স্থান থাকত তাহলে তাঁর নাম চেয়ারম্যানের পরেই থাকা উচিত ছিল। শান্তা সরকার এই সত্যটা যত তাড়াতাড়ি বুঝে যান ততই ভাল বলে মনে করছেন দক্ষিণ ২৪ পরগণা জেলা তৃণমূল কংগ্রেসের নেতৃত্বের একটা অংশ।
ভাইস-চেয়ারপার্সন থেকে শান্তা সরকার-কে শুধু আপাতত সরিয়েই দেওয়া হয়নি। সাময়িকভাবে সেই পদে নতুন কোনও ভাইস-চেয়ারম্যানও নিয়োগ করা হয়নি। ভাইস-চেয়ারপার্সন পদে থাকাকালীন শান্তা সরকার যে দফতরগুলি দেখভাল করতেন, সেই দফতরগুলি আপাতত চেয়ারম্যান ডক্টর পল্লব দাস নিজে দেখভাল করবেন বলে ঠিক হয়েছে। নতুন কোনও ভাইস-চেয়ারম্যান নিয়োগ না করে আপাতত পদটিকে নিস্ক্রিয় করে রাখা হচ্ছে বলেই পুরসভার সূত্রে খবর। সম্প্রতি শান্তার দুর্নীতি নিয়ে সরব হয়েছিলেন সোনারপুর-রাজপুর পুরসভার পুরপিতা ডক্টর পল্লব দাস। তাঁকে বাড়িতে ঢুকে স্ত্রী ও মেয়ের সামনে শান্তার দাদা সঞ্জীব সরকার ও তাঁর দলবল হেনস্থা করে বলেও অভিযোগ। এমনকী পৌরপ্রধানকে থুঁতুর ছিঁটেও দেওয়া হয়। শান্তা সরকার এতদিন ছিলেন ভাইস-চেয়ারপার্সন, শনিবার থেকে তিনি পরিণত হলেন সাধারণ এক কাউন্সিলারে। শান্তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ এতটাই প্রবল যে তাঁকে পুরসভার কোনও দায়িত্বে রাখা হয়নি। আপাতত তিনি সোনারপুর-রাজপুর পুরসভার ২১ নম্বর ওয়ার্ডের একজন সাধারণ কাউন্সিলার হিসাবেই কাজ করবেন। শান্তার কাছে ছিল বিল্ডিং প্ল্যানিং, পিএনসিপি, সাধারণ প্রশাসন ও মিউটেশনের মতো দফতর। এগুলি সবই তাঁর কাছ থেকে কেড়ে নেওয়া হয়েছে। সোনারপুর-রাজপুর পুরসভার পক্ষ থেকে শুক্রবার একটি বিজ্ঞপ্তি জারি করা হয়েছে, তাতে পৌরপ্রধান পারিষদ নতুন করে গঠনের কথা জানানো হয়েছে। এতে শান্তার নাম কোথাও নেই। পৌরপ্রধান পারিষদ-এর পুনর্গঠনের পর যে তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে তাতে পৌরপ্রধান ডক্টর পল্লব দাসের নাম সবার উপরে রয়েছে। এরপরে রয়েছে নজরুল আলি মণ্ডল, বিভাস মুখোপাধ্যায়, রঞ্জিত মণ্ডল, অমিতাভ চৌধুরী, কার্তিক বিশ্বাস। এই তালিকার কোথাও শান্তা সরকারের নামই নেই। দক্ষিণ ২৪ পরগণা জেলা তৃণমূল কংগ্রেস সভাপতি শুভাশিস চক্রবর্তী-র কাছেও শান্তা সরকারের দুর্নীতি নিয়ে একের পর এক অভিযোগ জমা পড়েছে। লোকসভা নির্বাচন থাকায় এই নিয়ে সিদ্ধান্ত ঝুলিয়ে রেখেছিল দক্ষিণ ২৪ পরগণা জেলা তৃণমূল কংগ্রেস। তারা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দিকেই তাকিয়ে ছিলেন। লোকসভা নির্বাচনে তৃণমূল কংগ্রেসের আসন সংখ্যা কমার পিছনে অনেকেই কাটমানি ও তোলাবাজি-কে দায়ী করেছেন। এরপরই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কাটমানি নিয়ে কড়া বার্তা দিয়ে আসছেন। আর সেই কারণেই এবার ক্ষমতা কেড়ে নেওয়া হল শান্তা সরকারের। আর লোকসভা নির্বাচনে সোনারপুর দক্ষিণের ফল খারাপের পিছনে অনেকটা দায়ী সঞ্জীব সরকার (পিঙ্কু)। তার বহুদিন যাবত তলাবাজি, জীবন মুখার্জির বিরুদ্ধে গোষ্ঠীবাজি, স্থানীয় কর্মী ও নেতৃত্বদের সাথে অসহযোগিতা প্রধান কারণ।আজ শান্তা সরকারকে পদ থেকে সরিয়ে দিয়ে কড়া বার্তা দেওয়া হল পিঙ্কু সরকারকেও বলে মনে করছে সোনারপুরের অধিকাংশ নেতৃত্ব। মমতা ব্যানার্জির এই কড়া সিদ্ধান্তে রাজপুর সোনারপুরের অধিকাংশ পুর প্রতিনিধি আজ খুশি, শুধুমাত্র পিঙ্কু সরকার ঘনিষ্ট হাতে গোনা কয়েকজন বাদে। এবার আশা করা যায় রাজপুর সোনারপুর পুরসভা কিছুটা শান্তিতে ও সুষ্ঠভাবে চলবে।জানি হয়তো এই প্রতিবেদনের পর আবার হুমকি দিয়ে ফোন আসতে পারে। তাতে আমরা কোনভাবে ভিত নই কারণ আমরা সত্যটাকে সত্য বলে তুলে ধরতে ভালবাসি।