ঝাঁসির রাণী লক্ষ্মী বাই-এর বোনঝি গঙ্গাবাই বাংলায় সুখিয়া স্ট্রিটে নারী শিক্ষার প্রসার ঘটিয়েছেন মহাকালী পাঠশালা
অম্বর ভট্টাচার্য, তকমা নিউজ, কলকাতা, ৭ই জুলাই ২০২৩ : কি ভাবছেন? কোথায় ঝাঁসির রানী লক্ষ্মী বাই আর কোথায় বাংলার নারী শিক্ষা? সিপাহী বিদ্রোহের ফলে, বাংলা পেয়েছিল এক সংগ্রামী মহীয়সী নারীকে। যিনি এই কলকাতায় নারী শিক্ষায় বিশেষ ভূমিকা নিয়েছিলেন। সেই আশ্চর্য্য ঘটনার কথা, আমাদের ইতিহাস আমাদের জানায় না।
মহারানী গঙ্গাবাই, যাঁর মাসিমা ছিলেন ইতিহাস প্রসিদ্ধ মহারানী লক্ষীবাই। গঙ্গবাই ছিলেন রায়বেলুড়ের রাজা নারায়ণ রাও-এর কন্যা। রাজ্যশাসন থেকে যুদ্ধে সেনাদলকে নেতৃত্ব দিতে, তুখোর ছিলেন গঙ্গাবাই। গঙ্গাবাই আর লক্ষীবাই ছিলেন প্রায় সমবয়স্ক। কথিত আছে, সিপাহী বিদ্রোহের সময় লক্ষ্মীবাই-য়ের সঙ্গে থেকে, অসামান্য সাহস ও তেজস্বিতা দেখিয়েছিলেন গঙ্গাবাই। কথিত আছে, তরো’য়াল হাতে বি’দ্রোহী দুই নারীর ল’ড়াই নাকি অবাক হয়ে দেখতো ইংরেজরা…
লক্ষ্মীবাই ও গঙ্গাবাই, দুজনেই সেই সময়ের সমাজের তুলনায় মানসিকতায় অনেক এগিয়েছিলেন। ১৮৫৭-র দশকে তাঁরা মনে করতেন, ভারতীয় সমাজে নারীদের শিক্ষার ও বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে তাদের এগিয়ে আসার খুব দরকার। যেটা তাঁরা নিজেরাও দেখিয়ে দিয়েছিলেন…
সিপাহি বিদ্রোহ ব্যর্থ হলে, ইংরেজদের হাত থেকে বাঁচতে, লক্ষ্মীবাই এর প্রিয় গঙ্গাবাই নানাসাহেবের সঙ্গে নেপালে পালিয়ে প্রায় ত্রিশ বছর লুকিয়েছিলেন। নেপাল থেকে ঊনবিংশ শতাব্দীর আটের দশকে কলকাতায় এসে, মেয়েদের সামাজিক অবস্থা ও নারীশিক্ষার বেহাল অবস্থা দেখে চমকে উঠলেন গঙ্গাবাই। কত কি শুনেছিলেন, সেই বাংলার এই হাল..
১৮৯০ সালে ৩৫ সি সুকিয়া স্ট্রিটে, একটি বালিকা বিদ্যালয় খুললেন গঙ্গাবাই। নাম, আদি মহাকালী পাঠশালা। প্রধানত নারী শিক্ষা ও হিন্দু মেয়েদের মনে হিন্দুধ’র্মের প্রতি শ্রদ্ধা জাগানোর জন্যই, তৈরি হয়েছিল মহাকালী পাঠশালা। গঙ্গাবাই নিজের ঘনিষ্ঠদের কাছে, মাতাজি মহারানী তপস্বিনী নামেই পরিচিত ছিলেন।
তবে বাইরের জগৎ, তাঁকে পুরুষ হিসাবেই জানত। কারণ বাড়ির বাইরে বেরোলেই তাঁর সাজ হত, পুরুষের মত। সবসময় তিনি পুরুষের বেশেই থাকতেন। পরতেন ধুতি পাঞ্জাবি। বোধহয় আত্মগো’পন করে থাকার সময়েই, এই পোষাকে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলেন তিনি।
১৮৯৩ সালের ১৯শে এপ্রিল, স্থাপিত হয় মহাকালী পাঠশালা। মহিলাদের জন্য সম্পূর্ন অবৈতনিক পাঠশালা। বিদ্যালয়টি স্থাপিত হয়েছিল, কাশিমবাজারের মহারানী স্বর্ণময়ী দেবীর আপার সার্কুলার রোডের বাড়িতে। পরে ছাত্রী সংখ্যা অনেক বেড়ে যাওয়ায়, বিদ্যালয়টি সরিয়ে আনা হয়, চোরবাগানে রাজেন্দ্র মল্লিকের বাড়ির কাছে একটি বাড়িতে। পরে সুকিয়া স্ট্রিটে বর্তমানে কৈলাস বসু স্ট্রিটে জমি কিনে, বিদ্যালয়ের নিজস্ব ভবন তৈরি হয়।
এই বিদ্যালয়ের বৈশিষ্ট্য ছিল উল্লেখযোগ্য। ইতিহাস, ভূগোল, বিজ্ঞান, পড়াশোনার পাশাপাশি বারো মাসে তের পার্বণ পালন করা হত, রান্নার শিক্ষা দেওয়া হত, শিবরাত্রি, গুরুপূর্ণিমা, দুর্গাপুজো, কালীপুজো উৎসব পালন করা হত আর পুরাণ নিয়ে আলোচনা হত। মেয়েদের স্বয়ংসম্পূর্ণা করে গড়ে তোলাই ছিল, মহারানী গঙ্গাবাই’য়ের আসল উদ্দেশ্য। যে স্বপ্নটা দেখতেন মহারানী লক্ষ্মীবাই…..
মহারানী গঙ্গাবাই কলকাতায় হয়ে উঠলেন মাতাজী। মাতাজীর স্কুলের নাম এতটাই ছড়িয়ে পড়ে যে, স্বামী বিবেকানন্দ, ভগিনী নিবেদিতা, দ্বারভাঙার মহারাজা, বর্ধমানের মহারাজা, সেকালের বড়লাট, ছোটলাট, আরও অনেকেই দেখতে এসেছিলেন। মাতাজির বিদ্যালয়, আদি মহাকালী পাঠশালা নামে আজও বিরাজ করছে। মাতাজীর বিদ্যালয় দেখে, সেই আমলে বাংলায় আরও বেশ কিছু নারীশিক্ষা কেন্দ্র গড়ে উঠেছিল।
রাজা রামমোহন রায় ও ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের হাত ধরে যে নারী শিক্ষা আন্দোলন বাংলায় শুরু হয়েছিল, মহারানী গঙ্গাবাই যেন ছিলেন তারই একজন সৈনিক। সিপাহী বিদ্রোহে ইংরেজদের বিরুদ্ধে লড়াই করা রাণী, লড়েছিলেন কলকাতার তৎকালীন সমাজব্যবস্থার বিরুদ্ধে। অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াই যার রক্তে থাকে, তাঁকে কি আটকানো যায়….?
কলকাতা তথা বাংলার নারীশিক্ষার ইতিহাসে, গঙ্গাবাই-য়ের নাম শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করা দরকার…তবে কজন এই ইতিহাস জানেন…
ভারতের ইতিহাসে লক্ষ্মীবাই থাকলেও, গঙ্গাবাই নেই। কলকাতার তৎকালীন সাহিত্য ও প্রামাণ্য তথ্য, আজও মাতাজী গঙ্গাবাই-য়ের স্মৃতি বয়ে নিয়ে যাচ্ছে…তবে সবটাই থেকে গেছে সাধারণ মানুষের জানার বাইরে…